ঈদুল আজহার পরপরই রাজধানীর লালবাগের পোস্তা, সাভারের হেমায়েতপুর ও দেশের বিভিন্ন চামড়া হাটে ভিড় করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। লক্ষ্য একটাই— কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করে কিছু মুনাফা করা। কিন্তু এবারও প্রত্যাশিত দাম না পেয়ে হতাশ হয়েছেন তারা। একদিকে বাজারে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার অভিযোগ, অন্যদিকে সংরক্ষণ সংকট, লবণের অপ্রতুলতা এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব— সব মিলিয়ে আবারও দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে দেশের কাঁচা চামড়ার বাজারে।
পোস্তায় গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৮৫০ টাকা, ছাগলের চামড়া ১০ টাকা!
ঈদের দিন সকাল থেকেই রাজধানীর পোস্তায় আসতে থাকে চামড়া। ঢাকার বিভিন্ন থানা, শহরতলি ও পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে আসা মৌসুমি ব্যবসায়ীরা গরু, খাসি ও ছাগলের চামড়া সংগ্রহ করে একে একে হাজির হন এই ঐতিহ্যবাহী চামড়ার হাটে। কিন্তু দাম শুনে অনেকেই হতবাক।
মাঝারি আকারের গরুর চামড়া বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪০০ টাকা, আর বড় আকারেরটি ৮৫০ টাকায়। ছাগলের চামড়ার অবস্থা আরও শোচনীয়— প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১০ টাকায়, অনেক জায়গায় আবার ফেলে দিতেও দেখা গেছে।
একজন মৌসুমি ব্যবসায়ী ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, ‘এক হাজার ২০০টা চামড়া আছে। বিক্রি হয়নি। সর্বোচ্চ ৭০০ টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। গতবার তো ৯০০–১০০০ টাকা দিয়েছিল। এবার চরম ক্ষতিতে যাচ্ছি।’
সরকারি মূল্য নির্ধারণ বাস্তবে কার্যকর নয়
সরকার ২০২৫ সালের কোরবানির ঈদে ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ করেছে প্রতি বর্গফুটে ৬০–৬৫ টাকা, আর ঢাকার বাইরে ৫৫–৬০ টাকা। তবে বাস্তব বাজারে এই মূল্য কার্যকর হচ্ছে না বললেই চলে।
ঢাকার মগবাজার, খিলগাঁও, আজিমপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, অধিকাংশ মানুষ সরকার নির্ধারিত দামের এক-তৃতীয়াংশও পাচ্ছেন না। এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আবু ইউসুফ জানিয়েছেন, ‘গত বছর যে চামড়াটা দেড়শ টাকায় বিক্রি করেছিলাম, এবার ৩০০ টাকা প্রস্তাব পেলাম। কিন্তু সেটাও বিক্রি করিনি। এভাবে সরকারি দর নির্ধারণ করে লাভ কী?’
মগবাজারের গ্রীনওয়ে এলাকায় দেখা গেছে, চামড়া নিয়ে ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন অনেকে, কেউ আসছে না। একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ট্যানারির লোকজন সময়মতো আসছে না, ফলে তারা নিরুপায় হয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করছেন।
আড়তদার ও ট্যানারির যুক্তি, ব্যয় বেশি, মান খারাপ
আড়তদাররা বলছেন, কাঁচা চামড়ার গায়ে গুটি বা দাগ পড়ার কারণে ট্যানারিরা আগ্রহ হারাচ্ছে। একজন আড়তদার বলেন, ‘গুটির মতো দাগ দেখলে ট্যানারিওয়ালারা দামই দেয় না। শ্রমিক, লবণ, গাড়িভাড়া— সবকিছু মিলিয়ে খরচ বেড়েছে। ভালোমানের চামড়া ছাড়া লাভ থাকে না।’
অন্যদিকে ট্যানারি মালিকরা বলছেন, এখন শুধুমাত্র ঢাকার চামড়াই পাওয়া যাচ্ছে, বাইরের জেলার চামড়া এখনও আসেনি। ফলে সরবরাহ কম থাকলেও মানসম্পন্ন চামড়ার অভাব দেখা দিয়েছে।
চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রাও কমবে, শঙ্কা ব্যবসায়ী সংগঠনের
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান জানিয়েছেন, ‘গত বছর আমাদের ১ কোটি পিস চামড়া সংগ্রহ হয়েছিল। এবার সেটি ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ গরুর আমদানি কম হয়েছে, বাজারে আগ্রহও কম। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে, লবণের কৃত্রিম সংকট আবারও তৈরি করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে দাবি করেছি যেন লবণ সরবরাহ ও সংরক্ষণের বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করা হয়। লবণের সংকটের অজুহাতে অনেক ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছে।’
ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির অনুমতি— আশা ও শঙ্কা
চলতি বছর সরকার ৩৫ বছর পর ওয়েট ব্লু (প্রক্রিয়াজাত) চামড়া রফতানির অনুমতি দিয়েছে। অনেকেই এটিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন, কারণ এতে দেশের চামড়া রফতানি খাতে নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। তবে বাজারে এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব এখনও স্পষ্ট নয়।
রাজধানীর মানিক নগর বিশ্বরোড এলাকায় একটি এতিমখানার পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বেশ কিছু কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছে। এই চামড়া সংগ্রহ করা হাফেজ ফয়সাল বলেন, আমরা বিনামূল্যে চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে দিয়ে আসবো।
তিনি জানান, চামড়ার চাহিদা আগের বছরের চেয়ে একটু বেশি, তবে খুব বেশি নয়।
একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সিদ্দিক আলম বলেন, ‘২০ বছর আগে যেই চামড়া হাজার টাকায় বিক্রি হতো, সেটা গত কয়েক বছর ১০০-২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার কিছুটা বেড়ে ৩০০-৩৫০ টাকা হয়েছে। কিন্তু এটা কি যথেষ্ট? সরকার যদি সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই উন্নতিও স্থায়ী হবে না।’
সংরক্ষণের অভাবে আবারও নষ্ট হবে লাখো চামড়া?
বাংলাদেশে মোট কাঁচা চামড়ার ৫০-৬০ শতাংশ আসে কোরবানির ঈদের সময়। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, এবার কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার, প্রস্তুত ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ গবাদিপশু। তবে সংরক্ষণের ঘাটতি ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় প্রতিবছরই লক্ষাধিক চামড়া নষ্ট হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, ২০২৪ সালের কোরবানির ঈদে প্রথম দুই দিনেই প্রায় ৫ লাখ চামড়া সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এবারও একই দুর্দশা পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
চামড়া খাত বাঁচাতে করণীয় কী?
বিশ্লেষকরা বলছেন, চামড়া শিল্প খাত একটি সম্ভাবনাময় রফতানি খাত হলেও এর বাস্তবতা অত্যন্ত সংকটপূর্ণ। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের জন্য ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা, সিন্ডিকেট ভাঙা, চামড়া প্রক্রিয়াকরণে সরকারি তদারকি বাড়ানো, লবণ সরবরাহে স্বচ্ছতা আনা এবং ওয়েট ব্লু চামড়া রফতানির সুযোগ কার্যকরভাবে কাজে লাগানো জরুরি।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে চামড়া একটি মৌসুমি আয় ও আবেগের উৎস। এই খাতের প্রতি অবহেলা শুধু ব্যবসায়িক ক্ষতিই নয়, সামাজিক বৈষম্যও বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাই প্রয়োজন টেকসই ও পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা।