বিশ্ব অর্থনীতির দুই প্রধান শক্তি—চীন ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিনের বাণিজ্য যুদ্ধ শেষে এক ঐতিহাসিক বাণিজ্য সমঝোতায় পৌঁছেছে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে চলা শুল্ক দ্বন্দ্ব অবসানে উভয় দেশই একাধিক পদক্ষেপে সম্মত হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন বাজারে চীনা পণ্যের প্রবেশাধিকার আবারও সহজ হবে।
এই সমঝোতার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার রফতানিনির্ভর অর্থনীতিতে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, যে দেশটি চীনবিরোধী শুল্ক নীতির সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকসহ নানা পণ্য রফতানিতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এখন সেই বাজার হারানোর আতঙ্কে ভুগছে।
চীনের প্রত্যাবর্তন: হুমকির মুখে বাংলাদেশের রফতানি সাফল্য
২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে চীনের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র, যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিয়ে আনা হয় চীনা ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, যন্ত্রাংশ ও হালকা শিল্পজাত পণ্যের আমদানি। ওই শূন্যস্থান দখল করে নেয় বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, ভারত ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং সামগ্রী—সব খাতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু এখন চীনের উৎপাদন দক্ষতা, স্কেল, বিনিয়োগ ক্ষমতা এবং বিশ্বস্ত সরবরাহ চেইনের কারণে মার্কিন ক্রেতারা আবারও সস্তা ও মানসম্পন্ন পণ্যের জন্য চীনের দিকেই ঝুঁকবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘চীন এগিয়ে থাকবেই, আমরা আরও পিছিয়ে যাবো’, রফতানিকারকদের আশঙ্কা
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘চীন যদি যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কহীন বা কম শুল্কে প্রবেশ করে, আর বাংলাদেশকে যদি ১০ শতাংশ বা তার চেয়েও বেশি দিতে হয়, তাহলে আমরা এই বাজারে মার খেয়ে যাবো।’
তিনি আরও বলেন, ‘চীনের ইনফ্রাস্ট্রাকচার, উৎপাদন দক্ষতা, ফিনান্সিং এক্সেস এবং স্কেল বাংলাদেশ থেকে বহু গুণ এগিয়ে। এর মধ্যে যদি শুল্ক বৈষম্যও যুক্ত হয়, তাহলে প্রতিযোগিতার বাইরে চলে যেতে হবে আমাদের।’
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বাণিজ্য চাপ
২০২৫ সালের ২ এপ্রিল, হঠাৎ করে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। পরে তিন মাসের জন্য তা স্থগিত করা হয়। সেই স্থগিতাদেশের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৯ জুলাই। এর মধ্যে যদি কোনও চুক্তি না হয়, তাহলে ওই শুল্ক আবারও কার্যকর হবে।
শুল্কটি কার্যকর হলে তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য ও হালকা যন্ত্রাংশ রফতানিতে বড় ধাক্কা লাগবে। রফতানিকারকরা বলছেন, এতে হাজার কোটি টাকার অর্ডার বাতিল বা মূল্যছাড়ে বাধ্য হওয়া লাগবে।
বাণিজ্য চুক্তির জন্য সময়ের সঙ্গে লড়ছে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ এগ্রিমেন্ট’ সইয়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চুক্তির খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশাধিকার পেতে হলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ আইন ও বাণিজ্য নীতি’ অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ পাল্টা প্রস্তাবে বলেছে, ‘একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অন্য দেশের আইন অনুসরণ করা সম্ভব নয়।’ ঢাকা চায়, পারস্পরিক ভিত্তিতে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ হোক।
চূড়ান্ত আলোচনার কেন্দ্রে ড. খলিলুর রহমান
আলোচনার মূল দায়িত্বে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা হাই-রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান। তিনি বর্তমানে ওয়াশিংটনে অবস্থান করছেন। ২৬ জুন তিনি ইউএসটিআরের সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টার গোপন বৈঠক করেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে—
বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় থাকতে চায়, শুল্ক বৈষম্যে ক্ষতিগ্রস্ত নয়;
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, এলএনজি ও উড়োজাহাজ আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় আগ্রহী;
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চীনের মতো শুল্ক সুবিধা দাবি করছে না, কিন্তু ‘ন্যায্য সুযোগ’ প্রত্যাশা করছে।
নন-ডিসক্লোজার চুক্তিতে ধোঁয়াশা: অন্ধকারে ব্যবসায়ীরা
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ১২ জুন একটি নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই হয়, যেখানে বলা হয়েছে- দুই পক্ষই চুক্তির বিষয়বস্তু প্রকাশ করবে না। এতে বেসরকারি খাত ও রফতানিকারকরা বিশদ জানতে পারছে না, ফলে দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমরা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি বলেছেন, এখন সিরিয়াস হতে হবে। সরকারও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছে। তবে আমাদের আশঙ্কা, প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের ওপর যেন বেশি শুল্ক না পড়ে।’
তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য আলোচনার অগ্রগতির বিষয়ে তারা আশাবাদী। বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘দুই বা তিন জুলাইয়ের দিকে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল, যার নেতৃত্বে থাকবেন বাণিজ্য উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে ইউএসটিআরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আশা করছি, এ সফরের মাধ্যমে চূড়ান্ত চুক্তির পথে বড় ধরনের অগ্রগতি হবে এবং একটি ইতিবাচক ফল আসবে।’
৯ জুলাইয়ের মধ্যে চুক্তি না হলে কী হবে—এমন প্রশ্নে মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি বাস্তবতাভিত্তিকভাবে বিবেচনা করবে। সমঝোতা না হলে তারা সময় আরও কিছুটা বাড়াবে। আমরা অন্তত সেটাই আশা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার এবং ব্যবসায়ী মহল একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা চাচ্ছি যেন চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বজায় থাকে এবং অগ্রহণযোগ্য হারে বাড়তি শুল্ক আরোপ না হয়।’
বাংলাদেশের পাল্টা কৌশল: আমদানি বাড়িয়ে বার্তা
বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে কয়েকটি কৌশল নিচ্ছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে--
১. গম আমদানি: ইউক্রেন থেকে গম আমদানির প্রস্তাব বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির সিদ্ধান্ত।
২. বোয়িং বিমান: বাংলাদেশ বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় বোয়িং থেকে বিমান কেনার প্রক্রিয়ায়।
৩. এলএনজি: জ্বালানি বিভাগ স্পট মার্কেট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি আমদানিতে অনুমোদন দিয়েছে।
এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ দেখাতে চাইছে— শুধু রফতানি চায় না, বরং আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক হিসাব নিয়ে মতবিরোধ
যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করছে, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ওপর গড়ে ৭৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করছে। বাংলাদেশ এই হিসাবকে ভুল দাবি করে বলছে—প্রকৃত গড় শুল্ক ২০-২৫ শতাংশ। নতুন অর্থবছরের বাজেটে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত ১৯০টি পণ্যের শুল্কহার কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
ভিয়েতনাম-ভারতের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ সরকারের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল চুক্তি নিয়ে ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া এখনও প্রাথমিক আলোচনা পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ চুক্তির খসড়ায় পৌঁছে গেছে এবং এনডিএ সই করেছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, ‘চুক্তি সই করাই সব নয়। যদি শর্ত প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে যায়, তাহলে তাড়াহুড়ো করে সই করাও বুমেরাং হতে পারে।’
বাণিজ্য ভারসাম্যই আসল কারণ?
২০২৪ সালের বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি: ৮৩৬ কোটি মার্কিন ডলার
যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আমদানি: ২২১ কোটি মার্কিন ডলার
এই বিশাল বাণিজ্য উদ্বৃত্তই মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ সৃষ্টি করতে উদ্বুদ্ধ করেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সামনে সময়ের পরীক্ষা
চীন যখন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে আসছে, বাংলাদেশ তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। ৯ জুলাইয়ের আগেই যদি চুক্তি না হয়, তাহলে ৩৭ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক কার্যকর হবে, যা দেশের পোশাক শিল্পসহ অনেক রফতানি খাতের জন্য এক প্রকার ‘বিপর্যয়’ হয়ে উঠতে পারে।
সরকার এখনও আশাবাদী—ন্যায়ভিত্তিক, গ্রহণযোগ্য ও টেকসই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।