X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

যেভাবে সরকারের মুঠোয় যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক

গোলাম মওলা
২১ এপ্রিল ২০১৬, ২৩:০৭আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৬, ১৪:৩৮


ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ২০১৪ সালে ইসলামী ব্যাংকে স্বতন্ত্র পরিচালক ছিলেন ৫ জন। তাদের মধ্যে ৪ জনকে বিদায় নিতে হয়েছে গেল কয়েক মাসের মধ্যে। তারা হলেন, অধ্যাপক এন আর এম বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক ড. একে এম সদরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন ও মো.আবদুস সালাম। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই ৪ জনের মেয়াদ বাড়ানো থেকে বিরত থাকে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। সরকারের পছন্দের নতুন ৪ স্বতন্ত্র পরিচালককে বসানোর জন্য তাদের মেয়াদ বাড়ানো হয়নি বলে ব্যাংক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তাদের মতে, পরিচালনা পর্ষদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে ইসলামী ব্যাংককে হাতের মুঠোয় নিচ্ছে সরকার। ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।  
সূত্রের দাবি, স্বতন্ত্র পরিচালক ছাড়াও ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরকে বের দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হুমায়ুন বখতিয়ার ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে থাকলেও অচিরেই তাকেও বিদায় নিতে হতে পারে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের সভায় নতুন স্বতন্ত্র ৪ পরিচালককে অনুমোদন দেওয়া হয়।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকেও ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তনের পক্ষে একটি বার্তা দেওয়া হয়। যার প্রভাব দেখা যায়, বেশ কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে। পরিবর্তন আনা হয়, ব্যাংকের পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদেও। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ জাহেরের স্থানে বসানো হয় মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মোস্তফা আনোয়ারকে।
পাশাপাশি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বতন্ত্র পরিচালক ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান এন আর এম বোরহান উদ্দিনের বিরুদ্ধে রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। তার বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারে অভিযোগ হিসেবে  ‘সন্দেহজনক লেনদেন, অবৈধভাবে অর্জিত আয় দেশি-বিদেশি মুদ্রায় পাচার করার’কথা উল্লেখ করা হয়।  মামলার পর এন আর এম বোরহান উদ্দিনকে ব্যাংক থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। 

গেল কয়েক বছর ধরে জঙ্গি অর্থায়ন ছাড়াও রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থায়নের অভিযোগ ওঠে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে। এই ব্যাংককে জামায়াতমুক্ত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনে এই ব্যাংকটিকে জাতীয়করণের প্রস্তাব ছিল বিভিন্ন মহলের। গণজাগরণমঞ্চসহ নানা প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন, তরিকতপন্থী রাজনৈতিক দলেরও দাবি ছিল-ব্যাংকটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার। বিষয়গুলো তদন্ত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের আওতাধীন প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এদিকে, গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে জনস্বার্থ, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও ব্যাংকের জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের (আইবিবিএল) বিশেষ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই নিয়ন্ত্রণের কারণে ব্যাংকের দ্বিতীয় পর্যায়ের শীর্ষ নির্বাহী উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) নিয়োগের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে। এমনকি বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ডিএমডি নুরুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশে শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সবচেয়ে বড়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকটির পর্ষদে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাই ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য নীতিনির্ধারক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো। নির্বাহী ও নিচের পর্যায়েও ওই ঘরানার জনশক্তিই বেশি। ফলে ব্যাংকটি পরিচালিত হতো জামায়াতের আদর্শ নিয়ে। এ নিয়ে বর্তমান সরকারের সঙ্গে একটি শীতল সম্পর্ক বরাবরই রয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও নীতিনির্ধারক ইসলামী ব্যাংক নিয়ে কয়েক দফা বিরূপ মন্তব্য করেছেন।

সূত্র জানায়, ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহের এখন পলাতক। অন্য সাবেক চেয়ারম্যান মীর কাসেম আলীকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ডাদেশ। অন্যান্য পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার ইস্কান্দার আলী, ড. আবদুল হামিদ ফুয়াদ আল খতিব, মো. আবুল হোসাইন, নাসের আহমদ আল খোন্দকার, এএইচজি মহিউদ্দিন, ড. আরিফ সোলেমান।

আরও পড়তে পারেন:   ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে ইসলামী ব্যাংক: নিয়োগ পাচ্ছেন নতুন ৪ পরিচালক

ইসলামী ব্যাংককে সরকারের নিয়ন্ত্রণে  নেওয়া প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ইসলামী ব্যাংক একটি রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হোক বা একটি রাজনৈতিক দলের কল্যাণে পরিচালিত হোক, তা আমরা কেউ-ই চাই না। আমরা চাই, ব্যাংক যেন সাধারণ মানুষের কল্যাণে  ব্যবহৃত হয়। তিনি বলেন, যে পরিবর্তনের কথা শুনছি, কারা নিয়োগ পাচ্ছেন, তাদের নাম-পরিচয় জানার পর সে বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে। তারা যদি ব্যাংকিং করার জন্য সেখানে যান, এবং সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, তাহলে আমরা সাধুবাদ জানাব। আর যদি যেখানে গিয়ে আগের মতোই জামায়াত বা কোনও রাজনৈতিক দলের স্বার্থে কাজ করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। ইসলামী ব্যাংকে সাধারণ মানুষের আমানত রয়েছে। এ কারণে ইসলামী ব্যাংক সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হোক, এটা আমরা চাই।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কিনা, আমি জানি না। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি কোনও নির্দেশনা না দেয়, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করাই ভালো। আর ইসলামী ব্যাংক থেকে কোনও নতুন পরিচালকের বিষয়ে অনাপত্তি জানালে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি যেভাবে চেয়েছিলাম, সেভাবে হচ্ছে না।  যেটা শুনছি, কয়েকজন মানুষকে ইসলামী ব্যাংকে পাঠানো হচ্ছে। যারা শেয়ার নিয়ে যাক, অথবা স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবেই যাক। এভাবে হাতের মুঠোয় নেওয়াকে আমি গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ মনে করি না। তিনি বলেন, আমার প্রথম প্রস্তাব ছিল ইসলামী ব্যাংকে জাতীয়করণ করা। কোনও কারণে সেটি যদি সম্ভব না হয়, তাহলে দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো সেখানকার ম্যানেজমেন্ট পরিবর্তন করা।

এ প্রসঙ্গে ইন্টারপ্রেস নেটওয়ার্ক (আইপিএন)-এর সিনিয়র গবেষক আনোয়ারুল হক বলেন, সরকার যেভাবে ইসলামী ব্যাংকের দিকে নজর রেখেছে, তাতে মনে হচ্ছে, ব্যাংকটিকে সরকার হাতের মুঠোয় নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে, যাই হোক, গ্রাহকের মধ্যে যেন আস্থার সংকট সৃষ্টি না হয়। মনে রাখা দরকার, ইসলামী ব্যাংক একটি বড় ব্যাংক। এ ব্যাংকের গ্রাহক অনেক বেশি, তাই গ্রাহকের স্বার্থও অনেক। আমানত বেশি। এ কারণে, এমন কিছু করা যাবে না, যাতে গ্রাহকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এবং তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। 

ব্যাংকটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজালের নাম রয়েছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করতে মোবাইলে ফোন দেওয়া হয় তাকে। বুধবার বিকালে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  আমিও বাই দ্য বাই শুনেছি। আমি এখন পর্যন্ত এ বিষয়ক অফিসিয়ালি কোনও কাগজপত্র পাইনি। আপনি ব্যাংকের যারা মুখপাত্র তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। 

এরপর যোগাযোগ করা হলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  এ ব্যাপারে একটা প্রক্রিয়া চলছে। এ নিয়ে এখন কথা বলার কিছু নেই।

ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিয়োগপ্রাপ্ত প্রত্যেকের নাম সরাসরি সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০-২৫ জনের নাম প্রাথমিক তালিকায় থাকলেও চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাচ্ছেন ৪ জন।

বতর্মানে প্রতিষ্ঠানটির বিদেশি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), কুয়েত ফিন্যান্স হাউস, জর্ডান ইসলামিক ব্যাংক, বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক, ইসলামি ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং, আল রাজি কোম্পানি, জেদ্দার শেখ আহমেদ সালেহ জামনুন, ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব, দুবাই ইসলামি ব্যাংক, পাবলিক ইন্সটিটিউশন ফর সোশ্যাল সিকিউরিটি, কুয়েতের মিনিস্ট্রি অব আওকাফ এবং মিনিস্ট্রি অব জাস্টিজ ডিপার্টমেন্ট অব মাইনর অ্যাফেয়ার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বিদেশি পরিচালকরাও রয়েছেন পর্ষদে।

আরও পড়তে পারেন:  বিসিএস ২৬ ক্যাডার বিসিএস ২৬ ক্যাডারের বেতন-স্কেল পুনর্বিন্যাসে জটিলতা কমেনি

২০১৪ সালের শেষ দিকে দু’দফায় ৭০ লাখ শেয়ার বিক্রি করেছে বিদেশি উদ্যোক্তা দুবাই ইসলামিক ব্যাংক। একই বছর ৪ লাখ ৬৫ হাজার শেয়ার বিক্রি করে বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক।

উল্লেখ্য, ১৯৮৩ সালের ১৩ মার্চ বাংলাদেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংক হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। ওই সময়ে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেও ছিল প্রথম ইসলামী ব্যাংক।

/এমএনএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
গরমে মরে যাচ্ছে শাকসবজি গাছ, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা চাষিদের
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়