যতই হোক– বাংলাদেশ একটি বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী, এবং তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে স্থবিরতা চললে সেটা আখেরে দিল্লি বা ঢাকা কারও জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না। এই বাস্তবতা থেকেই ভারতের উচিত ধীরে ধীরে আবার বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া এবং এখনই ‘ফুল এনগেজমেন্ট’ সম্ভব না হলেও ‘ট্র্যাক-টু’ বা সাংস্কৃতিক কূটনীতির মাধ্যমে নতুন করে যোগাযোগের রাস্তা খোলার চেষ্টা করা।
ভারতের পার্লামেন্টে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্ট্যান্ডিং (স্থায়ী) কমিটির বিশেষ বৈঠকে গত শুক্রবার (২৭ জুন) বিকালে ঠিক এই মর্মেই আলোচনা হয়েছে এবং কমিটির সদস্য বিভিন্ন দলের এমপিরাও এতে মোটের ওপর একমত হয়েছেন বলে বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে।
গত বছর থেকেই ভারতের পার্লামেন্টে এই প্রভাবশালী কমিটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছেন হাই-প্রোফাইল কংগ্রেস এমপি ও ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদদের একজন, শশী থারুর।
‘বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক’ শীর্ষক এই বিশেষ বৈঠকের পর আগামী দু-তিন সপ্তাহের মধ্যেই কমিটি তাদের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পার্লামেন্টে পেশ করবে বলে শশী থারুর জানিয়েছেন। তবে স্ট্যান্ডিং কমিটির আলোচনা একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক, কাজেই এই বৈঠকের আলোচনা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি।
তবে একটিমাত্র বিশেষ দেশের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটি আলাদা বৈঠক ডাকেছে, এমন ঘটনা খুবই বিরল। আর চেয়ারপারসন শশী থারুর শুধু বাংলাদেশ নিয়ে বৈঠকই ডাকেননি, এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত শুনতে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন সরকারের বাইরে থেকে চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকেও, ভারতে যারা বাংলাদেশ নিয়ে চর্চার জন্য পরিচিত।
এই বিশেষজ্ঞরা (‘এক্সটার্নাল এক্সপার্ট’) কমিটির সদস্য এমপিদের সামনে তাদের ব্যক্তিগত মতামত যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি এমপিদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দিয়েছেন। স্ট্যান্ডিং কমিটিতে একঝাঁক বাইরের বিশেষজ্ঞকে ডেকে পাঠানোর এই ঘটনাও প্রায় নজিরবিহীন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া এই চারজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন:
- ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তথা সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন
- লে. জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ আতা হাসনাইন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক সামরিক সচিব
- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ও ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলি দাস
- দিল্লির জেএনইউ-র অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ ড: অমিতাভ মাট্টু
শুক্রবার ওই বৈঠক চলেছে প্রায় আড়াই ঘন্টা ধরে। চেয়ারপারসন শশী থারুর ও বাইরের বিশেষজ্ঞরা ছাড়াও কমিটির সদস্য মোট ১৬ জন এমপি তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
গত বছরের ৫ অগাস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নাটকীয় পালাবদলের পর দু’দেশের সম্পর্কে যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে– সেই পটভূমিতেই যে এই বিশেষ বৈঠক ডাকা হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। বাংরাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কোন পথে যাবে, তা এখন ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি– আর সেই চিন্তারই প্রতিফলন ঘটেছিল শশী থারুরের ডাকা ওই বৈঠকে।
এখন প্রশ্ন হলো, নির্দিষ্ট কোন কোন বিষয় নিয়ে এমপি ও বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করলেন এবং কোন কোন বিষয়ে মোটের ওপর তারা একমত হলেন?
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক এমপি ও একাধিক বিশেষজ্ঞর সঙ্গে কথা বলে বাংলা ট্রিবিউন যা জানতে পেরেছে তা এরকম।
- গত বছরের অগাস্টে যা ঘটে গেছে, সেটাকে পেছনে ফেলে ভারতকে যে এখন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা (‘ফরোয়ার্ড লুকিং পলিসি’) কথা ভাবতে হবে, প্রায় সব সদস্যই সে বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছেন।
- দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মেরামত করার জন্য ভারতের দিক থেকে কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, সেটা নিয়েও নানা পরামর্শ এসেছে।
- কোনও কোনও এমপি বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভিসার কড়াকড়ি শিথিল করারও প্রস্তাব দিয়েছেন, তবে তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও ঐকমত্য হয়নি।
- কমিটিতে আগত বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন, বাংলাদেশে ভোট যখনই হোক– সে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকার ক্ষমতায় এলে ভারত যে তাদের সঙ্গে সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত– সেই বার্তা এখন থেকেই দিয়ে রাখা দরকার। একই সঙ্গে সে দেশের নির্বাচনটি যে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, ভারতের এই অবস্থানও বারবার পরিষ্কার করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তবে যতদিন অন্তর্বর্তী সরকার সে দেশে ক্ষমতায় আছে, ততদিন যে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব নয়, এটাও কমিটি কার্যত মেনে নিয়েছে।
- তবে যতদিন না পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার স্থাপিত হচ্ছে, ততদিন সাংস্কৃতিক পর্যায়ে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আদানপ্রদানের ভেতর দিয়ে (পিপল-টু-পিপল কনট্যাক্ট) দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার ওপর অনেকই জোর দিয়েছেন।
- বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহ সম্প্রতি কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে এই লক্ষ্যেই পদক্ষেপ নিয়েছেন – ভারতও সেটা ‘রেসিপ্রোকেট’ করতে পারে বলে বৈঠকে পরামর্শ এসেছে।
- একাধিক বিশেষজ্ঞ বৈঠকে বলেছেন, কূটনীতির স্বাভাবিক চ্যানেলগুলো যখন ঠিকমতো কাজ করে না তখন অ্যাকাডেমিক-বিশ্লেষক-সাবেক কূটনীতিবিদ বা সিভিল সোসাইটির সদস্যদের মাধ্যমে পর্দার আড়ালে ‘ট্র্যাক-টু’ আলোচনা জারি রাখা হয়; বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ভারতের এখন সেটা শুরু করা উচিত।
বৈঠকের শেষে আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কমিটির চেয়ারপারসন শশী থারুর ‘অন রেকর্ড’ কোনও মন্তব্য করেননি ঠিকই, তবে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমাদের (কমিটিকে) বলা হয়েছে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশ এখন অনেক কমে গেছে, মানে ভারতে সেখান থেকে আগের চেয়ে অনেক কম লোক আসছেন।’