X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আইএমএফের ঋণ সংকট কতটা দূর করবে

গোলাম মওলা
২৬ অক্টোবর ২০২২, ১৬:৩১আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০২২, ১৩:১১

গত বছরের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। এখন এই রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই রিজার্ভ ৩৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসবে। রিজার্ভ ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পর অর্থনীতির অন্যান্য সূচক নিম্নমুখী হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে সংকট আরও  ঘনীভূত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, কমে গেছে রফতানি আয়। কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহও। এমনকি বৈদেশিক ঋণও কমে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আইএমএফ থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই।

ঢাকায় এসেছে আইএমএফ প্রতিনিধি দল

ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে এসেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আর্থিক সংস্কার এবং নীতি নিয়ে আলোচনা করবেন আইএমএফ  প্রতিনিধি দল। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আইএমএফের মিশন প্রধান রাহুল আনন্দ।

বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)-এর কাছে ১০০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই পরিমাণ ঋণ যথেষ্ট কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট কাটিয়ে উঠতে আইএমএফ-এর ঋণ দেশের ভাবমূর্তি গড়ে তুলবে। তারা বলছেন, আইএমএফ থেকে ঋণ নিতে হলে শর্ত মানতে হবে। এক দশক আগে ভ্যাট আইন প্রণয়ন করার শর্তে বাংলাদেশ সাত কিস্তিতে আইএমএফ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের একটি বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) পেয়েছিল।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের-পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে আইএমএফ-এর ঋণ দরকার হবে। সরকার সেদিকেই নজর দিয়েছে। আইএমএফও ঋণ দিতে চাচ্ছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, সব উন্নয়নশীল দেশ দুটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। প্রথমত, অর্থ প্রদানের ভারসাম্যে বড় ঘাটতি এবং দ্বিতীয়ত, বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারার কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, অর্থনীতির এই সংকটকালীন পরিস্থিতিতে চাপ সামাল দিতে আইএমএফের ঋণটা খুবই জরুরি। যদি কিছু শর্ত মানতে হয়, সেটা মেনেও ঋণটা নিতে হবে। তার মতে, আইএমএফের ঋণ নেওয়ার মধ্যে দিয়ে মূল কাজ হবে ক্রাইসিস ঠেকানো। আইএমএফের ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। এই সময়ে আইএমএফ  আমাদের ঋণটা যদি দিয়ে দেয়, তাহলে বিশ্বব্যাংক পাশে থাকবে। তারাও ঋণ দেবে। এডিবি এগিয়ে আসবে। জাইকা আসবে। সবাই এগিয়ে আসবে।

এর আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আইএমএফের শর্তাবলি সম্পর্কে সাংবাদিকদের কিছু ধারণা দেন। এগুলো হলো—রাজস্ব প্রশাসনের আধুনিকায়ন, রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা, জিডিপি অনুপাতে কর আদায়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করা, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং খারাপ ঋণ কমানো।

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে এখনই বাস্তবায়ন জরুরি নয়—এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ স্থগিত রাখাসহ নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে।

আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে চাল, গম ও ডালের মতো খাদ্যশস্যের আমদানি কমে গেছে।

গত সাত বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে অর্থবছরের প্রথম চার মাসে। দেশের প্রধান তিনটি খাদ্যশস্যের আমদানি কমেছে ৩৭ শতাংশ।

চাহিদা পূরণে চলতি অর্থবছরে অন্তত এক কোটি টন গম ও চাল আমদানির প্রয়োজন হবে বলে মনে করা হচ্ছে। অথচ খাদ্যশস্য আমদানি কমছে। কেবল চাল ও গমই নয়, কমেছে ডাল আমদানিও। এই তিন পণ্যই হচ্ছে দেশের প্রধান তিন খাদ্যশস্য। এমন সময়ে এসব পণ্যের আমদানি কমছে, যখন আগামী বছরে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।

২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আমদানি বরং আগের তুলনায় কমেছে। কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা ডলার সংকটে ব্যাংকে চাহিদা অনুযায়ী ঋণপত্র খুলতে না পারার কথা জানিয়েছেন।

ডলারের দর নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় অনেকেই ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। পাশাপাশি উৎস দেশ সীমিত হয়ে যাওয়ার প্রভাব আমদানিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রায় চার মাসে (১ জুলাই থেকে ২১ অক্টোবর) চাল, ডাল ও গম আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ২৪ লাখ ৪৬ হাজার টন। এক বছরের ব্যবধানে আমদানি ৯ লাখ ১২ হাজার টন বা ৩৭ শতাংশ কমেছে। শুধু গত অর্থবছরই নয়, গত সাত অর্থবছরে একই সময়ে এবারের আমদানি হয়েছে সবচেয়ে কম।

এদিকে খাদ্যশস্য আমদানিকারকের সংখ্যাও কমেছে। পাম তেল, সয়াবিন তেল ও চিনিতে যেমন গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, খাদ্যশস্যে তা নেই। ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য আমদানি করেন। চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত ৩৪৮টি প্রতিষ্ঠান খাদ্যশস্য আমদানি করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে ছিল ৪৯৩টি প্রতিষ্ঠান। অন্তত ১৪৫টি প্রতিষ্ঠান এবার আমদানি করেনি, যাদের বড় অংশই ছোট প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হচ্ছে, ডলার সংকটে ব্যাংকে ঋণপত্র খুলতে না পারায় ছোট ব্যবসায়ীরা আমদানি করতে পারছেন না।

জানা গেছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুই খাত প্রবাসী আয় ও পণ্য রফতানিতেও সুখবর নেই। গত মাসে একসঙ্গে দুই খাতের আয় কমেছে। চলতি মাসেও পণ্য রফতানি ইতিবাচক ধারায় ফেরার সম্ভাবনা কম। কারণ, সামগ্রিক রফতানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশের জোগানদাতা তৈরি পোশাকশিল্পের রফতানি চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমেছে।

তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি মাসের প্রথম ২০ দিনে (১ থেকে ২০ অক্টোবর) ১৭৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে। এই রফতানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ কম। গত বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম ২০ দিনে রফতানি হয়েছিল ২১৮ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।

চলতি অক্টোবর মাসের প্রথম ২০ দিনে দেশে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ১১০ কোটি মার্কিন ডলার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে মাস শেষে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭০ কোটি ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এই চিত্র পাওয়া গেছে। যদিও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে বিভিন্ন ছাড় দেওয়া হয়েছে, তবু এর গতি কম দেখা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে ১৫৪ কোটি ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এই অঙ্ক গত ৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অবশ্য অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিমাণের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। আগস্ট মাসে আসে ২০৩ কো‌টি ৭৮ লাখ (২ দশমিক ০৩ বিলিয়ন) ডলার। আর জুলাইয়ে আসে ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার।

বিদেশি ঋণ আসাও কমে গেছে। প্রতি মাসেই কমছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মোট ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ৩ মাসে ১৯৩ কোটি ৮০ লাখ (১.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ ছাড় করেছিল দাতারা।

অবশ্য গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় বিদেশি ঋণপ্রবাহের উল্লম্ফন নিয়ে শুরু হয়েছিল ২০২২-২৩ অর্থবছর। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রায় ৪৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ-সহায়তা এসেছিল, যা ছিল গত জুলাইয়ের চেয়ে ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ বেশি। কিন্তু দ্বিতীয় মাস আগস্টে এসে হোঁচট খায়। ওই মাসে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করে দাতারা, যা ছিল আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ কম।

তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে এসেছে ৪৮ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে অনেক কম বিদেশি ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ।

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ঋণ দেওয়ার আগে ভোটের ফল খতিয়ে দেখতে আইএমএফ’কে ইমরানের চিঠি
পাকিস্তান সফর করবে আইএমএফ প্রতিনিধি দল
যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা