X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংকে তারল্য কমলেও বাড়তে শুরু করেছে আমানত

গোলাম মওলা
১৬ মে ২০২৩, ২২:০০আপডেট : ১৬ মে ২০২৩, ২২:১৬

দেশের ব্যাংক খাতে টাকার প্রবাহ বা তারল্যের পরিমাণ কমছে। গত ৯ মাসে তারল্য কমেছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ব্যাংক থেকে টাকা বের হয়েছে বেশি, কিন্তু ব্যাংকে টাকা এসেছে কম। সাধারণত, ব্যাংকে ঋণের চেয়ে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। কিন্তু সম্প্রতি এ পরিস্থিতি উল্টে গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এখন আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে বেশি। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে আমানত বেড়েছে ১ দশমিক ১৪ শতাংশ। এর বিপরীতে একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ বেড়েছে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমানতের এই প্রবৃদ্ধি ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনও কাজ দেবে না। আমানতের এই ধীরগতি চলতে থাকলে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়া কমিয়ে দেবে।

তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ১০৪ টাকা ৫০ পয়সা দরে ডলার বিক্রি করছে। ফলে বাজার থেকে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চলে গেছে। অন্যদিকে টাকা ডলারে কনভার্ট হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাতে ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। তারল্য কমে যাওয়ায় বেশ কিছু বিপদ রয়েছে। এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে শুধু ইসলামী ব্যাংককে সরকার ইতোমধ্যে ২৪ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। চলতি মার্চ শেষে (৯ মাসে) তারল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায়, যা ১৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। এর আগে করোনার সময় ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকিং খাতে তারল্য সর্বোচ্চ ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় উঠেছিল। এরপর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত তারল্য ওঠানামার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছিল। গত বছরের জুনের পর থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা শুরু হয়, যা এখনও অব্যাহত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে তারল্য কমার জন্য ছয়টি কারণকে শনাক্ত করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—করোনার পর হঠাৎ ঋণের চাহিদা বাড়ে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আমদানি ব্যয়ের মাত্রাতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি, ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে গ্রাহকদের হাতে রাখার প্রবণতা বেড়েছে। এ ছাড়া আমানত, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ হ্রাস এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া।

প্রসঙ্গত, আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় এবং ব্যাংকের ঝুঁকি কমাতে মোট আমানতের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ জমা হিসাবে রাখতে হয়। এরমধ্যে সাধারণ ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় মোট আমানতের ১৭ শতাংশ। ইসলামি ব্যাংকগুলোকে রাখতে হয় মোট আমানতের প্রায় ১০ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ২০২১ সালের জুনে ব্যাংকগুলোতে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে ব্যাংকে তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জুলাইয়ে তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকায়। আগস্টে আরও কমে ৪ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকায়। সেপ্টেম্বরে আরও কমে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায়। অক্টোবরে কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা। নভেম্বরে তারল্য কমে হয় ৪ লাখ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে আরও কমে ৩ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকায় নেমে যায়।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে তারল্য আরও কমে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে কমে হয় ৩ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। মার্চে সাময়িকভাবে হিসাবে তারল্য আরও কমে ৩ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে।

অবশ্য তারল্য কমলেও গত এক বছরে (মার্চ পর্যন্ত) আমানত বেড়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা। জানুয়ারির তুলনায় শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার আমানত বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে ব্যাংক খাতে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ২৩ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা, যা ২০২২ সালের মার্চে ছিল ১৪ লাখ ১৭ হাজার ২১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ আমানত বেড়েছে ৭ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে মার্চ মাসে আমানত বেড়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে আমানত বেড়েছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক খাতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। মার্চ শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ২৩ হাজার কোটি টাকা। সুদের হার বৃদ্ধি ও বিকল্প না থাকায় টাকা জমা রাখতে মানুষ আবারও ব্যাংকে ফিরছেন বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, কয়েক মাস ধরেই গ্রাহকদের আমানতের সুদহার বাড়িয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের মে মাসে যেখানে বার্ষিক আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ শতাংশ, সেখানে গত বছরের ডিসেম্বরে তা সাড়ে পাঁচ শতাংশে নেমে আসে। এত দিন চাইলেও তাদের ইচ্ছামাফিক সুদহার বাড়ানোর স্বাধীনতা ছিল না। এখন সেই স্বাধীনতা পেয়েছে ব্যাংকগুলো।

২০২০ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুযায়ী ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ ও আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল। সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে সেই সীমা তুলে দেওয়ার পর আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়িয়েছে। এখন গ্রাহকদের ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে কোনও কোনও ব্যাংক। যেখানে গত ডিসেম্বরে গড় সুদহার ছিল মাত্র ৪ শতাংশের কিছু বেশি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেশ কিছুদিন ব্যাংকে সুদের হার ছিল কম। এ ছাড়া নানা কারণে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছিল। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে জমি, ফ্ল্যাট বিলাস সামগ্রী কিনেছেন। কিন্তু এখন আমানতের সুদের হার বাড়ছে। এ কারণে ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ছে।

অবশ্য সুদের হার বৃদ্ধি ছাড়াও আমানত বৃদ্ধির পেছনে আরও তিনটি কারণ উল্লেখ করছেন ব্যাংকাররা। তাদের মতে, ইসলামী ব্যাংকের ঘটনায় ব্যাংক খাতে নিয়ে গ্রাহকদের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছিল, তা এখন অনেকটা কেটেছে। বিনিয়োগের অন্য কোনও বিকল্প না থাকায় মানুষ ব্যাংকেই ফিরে আসছেন। সেই সঙ্গে তারল্য সংকট কাটাতে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার ধীর নীতি অনুসরণ করছে।

যদিও এই পরিস্থিতির মধ্যে আমানত ও ঋণের ভারসাম্যপূর্ণ শৃঙ্খলা ভেঙে অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছে দেশের ১৭টি ব্যাংক। এতে শরিয়াহ ধারার তালিকাভুক্ত কয়েকটি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা নেওয়ার পরও অ্যাডভান্স ডিপোজিট রেশিও (এডিআর) বা আমানত ঋণ অনুপাত সংরক্ষণ করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী প্রচলিত ব্যাংকগুলো প্রতি ১০০ টাকা আমানতের জন্য ৮৭ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমা অতিক্রম করে ১৭টি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে প্রচলিত ধারার ন্যাশনাল ব্যাংকের এডিআর ৯৮ দশমিক ২৩ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ (ব্যাংকটির শরিয়াহ উইন্ডোর ১০৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ), রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের ৯১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং ওয়ান ব্যাংকের ৮৯ শতাংশ।

শরিয়াহ-ভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের এডিআর ছিল ১০০ দশমিক ২৮ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৯৬ দশমিক ২৮ শতাংশ, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডো ১৫৫ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ইসলামিক উইন্ডোর এডিআর ছিল ১৩৬ দশমিক ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া অন্য পাঁচটি শরিয়াহ-ভিত্তিক ব্যাংকের এডিআর ৯৩ দশমিক ০১ থেকে ১০৪ দশমিক ৫৪ শতাংশ ছিল। বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের এডিআর ৮৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। পাশাপাশি কমিউনিটি ব্যাংকের এডিআর ৮৮ দশমিক ২৮ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংকের ৮৮ দশমিক ০৫ শতাংশ এবং আইএফআইসি ব্যাংকের এডিআর ৮৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

/এনএআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পুরোপুরি বাজারভিত্তিক হচ্ছে ঋণের সুদহার
মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে আসবে: প্রতিমন্ত্রী
১০ মাসে এলো রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স
সর্বশেষ খবর
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী