২০১৭ সালের পর থেকে কাঁচা চামড়ার কদর কমেছে। গত বছরও একই দশা ছিল। রাজধানীসহ সারা দেশেই কাঁচা চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েন কোরবানিদাতারা। তবে এবার কাঁচা চামড়ার কদর কিছুটা বাড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। মৌসুমি ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটিই জানা গেছে।
মৌসুমি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, তারা গত বছর কোরবানির পশুর চামড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কিছুটা কমে কিনলেও এবার চেষ্টা করবেন সরকারের বেঁধে দেওয়া নির্ধারিত দামে নিতে।
রাজধানীর হাজারীবাগের মৌসুমি ব্যবসায়ী পারভেজ আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এবার কাঁচা চামড়ার চাহিদা বেড়েছে। পরিবেশও ভালো আছে। আশা করা যায়, বিগত বছরের মতো এবার কোরবানিদাতাদের ভোগান্তি হবে না। এবার কোরবানির পশুর চামড়ার কদর কিছুটা বাড়বে। আমরা সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কিনবো। গতবারের চেয়ে এবার বড় গরুর প্রতি চামড়ায় গড়ে ২০০ টাকার বেশি দাম থাকবে বলেও জানান তিনি।
রাজধানীর লালবাগের পোস্তার ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে বর্তমানে বড় দানার লবণের সরবরাহ ঠিক আছে। গত বছর কোরবানির সময়ের তুলনায় এবার লবণের দাম কমেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা তাদের জন্য এবার সহজ হবে। পোস্তার একাধিক কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, গতবারের চেয়ে এবার বড় ও ভালো মানের কাঁচা চামড়ার দাম একটু বাড়বে।
চলতি বছর কোরবানির সময় ১ লাখ ৬০ হাজার পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তা এলাকার আড়তদারেরা। তারা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার লবণযুক্ত চামড়ার দাম বেড়েছে। এ ছাড়া আবহাওয়াও এখনও পর্যন্ত ঠিক আছে। তাই তারা আশা করছেন— লবণ দেওয়ার উদ্দেশ্যে লক্ষ্য অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ করতে পারবেন। আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কিনলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের লোকসান হবে না। পোস্তার একাধিক ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকারের নির্ধারিত দামে লবণযুক্ত চামড়া কিনবেন তারা।
এ প্রসঙ্গে পোস্তার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আফতাব খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার লবণের রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদন হওয়ায় আশা করছি— লবণের দাম সহনশীল থাকবে। সেক্ষেত্রে চামড়ার দাম এবার কিছুটা বাড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে আমরা ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’ তিনি জানান, লালবাগের পোস্তার পাশাপাশি ঢাকার আশপাশের বেশকিছু এলাকাতেও লবণ দিয়ে চামড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত বছর কোরবানির ঈদে বড় আকারের (৩০-৩২ বর্গফুট) গরুর চামড়া ৯০০ টাকা ও মাঝারি আকারের (২০-২২ বর্গফুট) চামড়া ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছোট গরুর চামড়া ৫০০ টাকা, ছাগলের চামড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত বছর কোথাও কোথাও বড় আকারের (৩৫ বর্গফুট) গরুর চামড়া ১২০০ টাকা, মাঝারি আকারের (২২-২৫ বর্গফুট) ৮০০-৯০০ টাকা এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পোস্তার ব্যবসায়ীরা জানান, গতবারের চেয়ে এবার সব ধরনের চামড়ার দাম কিছুটা বাড়তি থাকবে। পাইকারদের সেভাবেই চামড়া কেনার জন্য তারা বলে দিয়েছেন। মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও এবার ভালো মুনাফা করতে পারবেন বলে জানান একাধিক আড়তদার।
লালবাগের ব্যবসায়ীরা বলেন, গত বছর ৭৪ কেজির বড় দানার লবণের প্রতি বস্তার দাম ছিল ১ হাজার ৩৫০ টাকা, এ বছর তা কমে ১ হাজার ৫০ টাকা হয়েছে। অবশ্য চামড়ায় লবণ দেওয়ার জন্য শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। এ বছর প্রতিটি চামড়ায় লবণ দেওয়ার বিপরীতে ৮৫-১০০ টাকা মজুরি চাচ্ছেন কারিগরেরা। গত বছর এই মজুরি ছিল ৭০-৭৫ টাকা।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তার চামড়ার আড়তগুলো কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার অন্যতম বড় জায়গা। এই এলাকায় বর্তমানে ৩৭টি কাঁচা চামড়ার আড়ত আছে। রবিবার ( ১৬ জুন ) সকালে পোস্তা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন লালবাগের পোস্তার আড়তদাররা। পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও ঢাকা ও আশেপাশের এলাকায় জবাই হওয়া পশুর চামড়া কেনার পরিকল্পনা করেছেন। এজন্য তারা নিজের পুঁজির পাশাপাশি ধার-দেনা করে কোরবানির পশুর চামড়া কেনার টাকা সংগ্রহ করেছেন। লালবাগ এলাকায় দেখা গেছে, অধিকাংশ আড়তে ব্লিচিং পাউডার ও পানি দিয়ে ধুয়ে-মুছে কাঁচা চামড়া সংরক্ষণের জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে। পুরনো চামড়া সরিয়ে আড়তগুলোতে শত শত লবণের বস্তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অতিরিক্ত লবণ রাখার জন্য আড়তের ভেতরে ফাঁকা জায়গাও রাখা হয়েছে।
পোস্তার পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, সারা বছরে যে পরিমাণ চামড়া পোস্তায় আসে, তার প্রায় অর্ধেকই আসে কোরবানির ঈদের মৌসুমে। এ জন্য বাড়তি প্রস্তুতি নিয়েছেন। আগামীকাল সোমবার কোরবানির ঈদের দিন সকাল থেকেই চামড়া সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করেন পোস্তার আড়তদারেরা। মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চামড়া কেনেন তারা। এরপর আড়তে এনে লবণ দেন। ঈদের তৃতীয় দিন পর্যন্ত চলে চামড়া সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কার্যক্রম।
সাধারণত পশুর চামড়া ছাড়ানোর ৪ থেকে ৯ ঘণ্টার মধ্যে লবণ দিয়ে তা সংরক্ষণ করতে হয়। তা না হলে চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। তাই এ বছর চামড়া সংরক্ষণের দিকেই বেশি নজর দিচ্ছেন আড়তদারেরা।
এদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এ বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, গত বছর যা ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অপরদিকে ঢাকার বাইরে গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, গত বছর যা ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। অর্থাৎ এ বছর ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট গত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ ৫ টাকা, আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ৭ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়ার দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এদিকে এবারের কোরবানি ঈদে কাঁচা চামড়া কেনা ও সংরক্ষণে ট্যানারিগুলোতে অর্থায়ন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংকগুলো। গত বছরের চেয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকা বেশি ঋণ পাবেন ট্যানারি মালিকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ট্যানারিগুলোকে এবার ২৭০ কোটি টাকা ঋণ দেবে ব্যাংকগুলো। যদিও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চামড়ার বাজার দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার। সেই বাজারের জন্য ২৭০ কোটি টাকা খুবই অল্প। এত বড় বাজারে কোনোভাবে এর প্রভাব পড়বে না।’ তিনি বলেন, ‘মৌসুমি ব্যবসায়ী, মসজিদ ও মাদ্রাসাভিত্তিক যেসব ব্যক্তি চামড়া সংগ্রহ করবেন, তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখছি। আশা করছি, এবার সবমিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ১৫-২০ লাখ চামড়া সংগ্রহ করা সম্ভব হবে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছর গরু, ছাগল, ভেড়া ও উট মিলিয়ে ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার ৩৬৭টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার পশুর সংখ্যা বেড়েছে ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৪টি। কোরবানির যোগ্য পশুর মধ্যে ৫২ লাখ ৬৮৪টি গরু, ১ লাখ ৬০ হাজার ৩২০টি মহিষ, ছাগল ৬৮ লাখ ৫০ হাজার ৫৮টি, ভেড়া ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪৩টি। ১৮৫০টি পশু অন্য প্রজাতির। এ বছর বিভাগীয় পর্যায়ের তথ্যানুযায়ী, কোরবানিযোগ্য গবাদিপশুর সর্বোচ্চ সম্ভাব্য চাহিদা ১ কোটি ৭ লাখ ২ হাজার ৩৯৪টি।
সাধারণত মসজিদ বা মাদ্রাসায় পশুর চামড়া দান করেন অনেকে কিংবা কোরবানির স্থলে আগত পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। পাঁচ বছর আগেও একটি পূর্ণবয়স্ক গরুর চামড়া প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি করা যেতো। অথচ এক দশকে চামড়ার জুতার দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে! এবার ঢাকায় সরকার কর্তৃক প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার নির্ধারিত বিনিময় মূল্য ধরা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, ২০১৩ সালে যা ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা।