ঈদ সামনে এলেই নতুন নোট সংগ্রহের একধরনের উৎসবমুখরতা দেখা যায়। আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে ছোটদের ‘ঈদ সেলামি’ দিতে অনেকেই ব্যাংকে ভিড় করেন নতুন চকচকে নোটের জন্য। তবে এবার সেই আনন্দঘন প্রস্তুতির মাঝে দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা। সীমিত সরবরাহ, অনিয়মিত বিতরণ আর খোলাবাজারে অস্বাভাবিক দামে বিক্রির কারণে রাজধানীজুড়ে নতুন নোট নিয়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের হযবরল পরিস্থিতি। সাধারণ মানুষ পড়েছেন ভোগান্তিতে, আর বাড়তি মুনাফার সুযোগ নিচ্ছেন কিছু মৌসুমি ও প্রভাবশালী চক্র।
ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীর মতিঝিল ও গুলিস্তান এলাকায় নতুন টাকার কদর যেন আকাশ ছুঁয়েছে। বৃহস্পতিবার (৫ জুন) থেকে ব্যাংক ছুটির কারণে সরবরাহ সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এই সুযোগে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বান্ডিলপ্রতি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত আদায় করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শুক্রবার (৬ জুন) বিকালেও বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে নতুন নোট বেচাকেনা হতে দেখা যায়।
নতুন নোট ক্রেতারা বলছেন, ব্যাংকের কাউন্টারগুলোতে নতুন নোট না পাওয়ার কারণে তারা ফুটপাত ও খোলাবাজার থেকে কিনছেন অতিরিক্ত দামে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি না থাকায় সাধারণ গ্রাহকরা যেমন দুর্ভোগে পড়ছেন, তেমনই উৎসবপূর্ব এই সময়ে তৈরি হয়েছে এক ধরনের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য।
নতুন নোট, পুরনো জটিলতা
২ জুন বাজারে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নকশার ২০, ৫০ ও ১০০০ টাকার নোট। তবে সরবরাহ মাত্র ৫২০ কোটি টাকার, যেখানে সাধারণত ঈদের আগে ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট সরবরাহ করা হয়। এতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ঘাটতি তৈরি হওয়ায় ব্যাংকগুলোতেও মিলছে না প্রয়োজনীয় নতুন টাকা।
যেভাবে চলছে বেচাকেনা
২০ ও ৫০ টাকার নতুন নোটের বান্ডিলে ৮০০-১০০০ টাকা অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে।
১০০০ টাকার নতুন নোট প্রতি পিস ৩০-৪০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। পুরনো নকশার নতুন নোটেও ৪০০-৫০০ টাকা বেশি প্রতি বান্ডিলে।
খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারাও বাড়তি দামে এসব নোট সংগ্রহ করছেন। কেউ কেউ দাবি করেছেন, ব্যাংকের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে এসব নোট তাদের কাছে পৌঁছায়।
সাধারণ মানুষের ভোগান্তি
বেসরকারি চাকরিজীবী আসিফ খান বলেন, ‘একাধিক ব্যাংকে গিয়েও নতুন নোট না পেয়ে শেষ পর্যন্ত গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে ৫০ টাকার ১০টি নোট ১০০ টাকা বেশি দিয়ে কিনেছি। ঈদের বখশিশ দিতে হবে বলেই বাধ্য হয়েছি।’
নতুন নোট চেনার উপায়
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান হাবিব মনসুরের সই করা নতুন নোটগুলো শতভাগ সুতি কাগজে ছাপা হয়েছে। এতে যুক্ত হয়েছে বেঙ্গল টাইগারের জলছাপ ও জাতীয় স্থাপনার প্রতিকৃতি।
১০০০ টাকা: বেগুনি রঙে ছাপা, সামনে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, পেছনে সংসদ ভবন। ৫০ টাকা: গাঢ় বাদামি, সামনে আহসান মঞ্জিল, পেছনে জয়নুল আবেদিনের ‘সংগ্রাম’। ২০ টাকা: সবুজ রঙে, সামনে কান্তজিউ মন্দির, পেছনে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার।
ব্যাংকে নেই, ফুটপাথে রমরমা ব্যবসা
মতিঝিলের সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা, কৃষি ও ইসলামী ব্যাংকের শাখাগুলোতে নতুন নোট বিতরণের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে অন্তত ডজনখানেক বিক্রেতা ২০, ৫০ ও ১০০ টাকার বান্ডিল বিক্রি করছেন— প্রতিটি বান্ডিলে ১০০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত দামে।
উদাহরণস্বরূপ: ২০ টাকার একটি বান্ডিল (মূল্য ২০০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ টাকায়। ৫০ টাকার বান্ডিল বিক্রি হচ্ছে (মূল্য ৫০০০ টাকা) ৭০০০ টাকায়। ১০০ টাকার বান্ডিল (মূল্য ১০০০০ টাকা) বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকায়।
চলতি বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক আনুমানিক ৫২০ কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছেড়েছে। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংক গ্রাহকরা তেমন কিছুই পাচ্ছেন না। অথচ খোলাবাজারে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এক বান্ডিল (১০০ পিস) ২০, ৫০ বা ১০০ টাকার নোটে ৮০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন।
একজন বিক্রেতার কাছে দেখা গেছে, ৪-৫ লাখ টাকার নতুন নোটের মজুত, যা পরোক্ষভাবে ইঙ্গিত দেয় ব্যাংকিং ব্যবস্থার কোনও না কোনও স্তর থেকে এই কালোবাজারিকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
এটা কেবল চাহিদা ও সরবরাহের ফাঁক নয়, বরং এখানে সুস্পষ্টভাবে কাজ করছে একটি অসাধু সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকেই কিছু কর্মকর্তা ও তৃতীয় পক্ষের হাত ধরে বাজারে আসছে এই বিপুল পরিমাণ নোট।
ব্যাংক কর্মকর্তারাও পাচ্ছেন না প্রয়োজনীয় সরবরাহ
সোনালী ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা যে পরিমাণ নতুন নোট পেয়েছি, তাতে প্রতিটি শাখায় ন্যূনতম বিতরণ করাও সম্ভব না। রূপালী ও কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তারাও জানান, তারা নিজেরাও ২০ টাকার একটি বান্ডিল পর্যন্ত পাননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্বেগ, আসছে কঠোর ব্যবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “সপ্তাহের শুরু থেকেই ব্যাংকগুলোকে পর্যাপ্ত নতুন টাকা সরবরাহ করা হয়েছে। তবু গ্রাহকদের কাছ থেকে অভিযোগ পাচ্ছি। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, “কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা প্রাপ্ত নতুন টাকা সরাসরি গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ না করে অসাধু উপায়ে খোলাবাজারে সরবরাহ করেছেন। এতে প্রতি বান্ডিলে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত অবৈধ মুনাফা করছে একটি চক্র।”
তিনি আরও বলেন, “খোলাবাজারে নতুন নোট বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। বিষয়টি তদন্তাধীন এবং খুব শিগগিরই কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
অনেকেই বলছেন, খোলাবাজারে নোটের এমন অবাধ বিক্রি, তাতে অতিরিক্ত দাম এবং এর পেছনে থাকা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা, সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘নতুন নোট যখন ব্যাংকের কাউন্টারে পৌঁছানোর আগেই খোলাবাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়, তখন তা সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন নয়। যদি বিতরণে কার্যকর ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হতো, তাহলে সাধারণ মানুষ কখনোই অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে খোলাবাজার থেকে নতুন নোট কিনতে বাধ্য হতো না।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘এ ধরনের পরিস্থিতি স্পষ্টতই একটি নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার ইঙ্গিত দেয়, যা জনগণের আস্থার জন্য ক্ষতিকর।’’
পরিবর্তন আসছে ব্যবস্থাপনায়
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ইতোমধ্যে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। ভবিষ্যতে কোড ও ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে নতুন নোট বিতরণের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি বছর ঈদুল আজহাকে ঘিরে ছাপানো হয়েছে ৫২০ কোটি টাকার নতুন নোট। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় তা সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। বরং এসব নোট কালোবাজারির মাধ্যমে ফুটপাথে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।