মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক উত্তেজনা এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি অংশগ্রহণ আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করেছে। সরবরাহ চেইনে বিঘ্নের আশঙ্কায় বিশ্ববাজারে হু হু করে বাড়ছে অপরিশোধিত তেলের দাম, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়।
বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিরতায় উদ্বেগ আরও বেড়েছে ইরানের পার্লামেন্টে গৃহীত একটি প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে। ওই প্রস্তাবের পক্ষে হরমুজ প্রণালি বন্ধের পক্ষে কৌশলগত ভোট দেওয়া হয়েছে। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও নেয়নি দেশটির সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ, তবে এরইমধ্যে আশঙ্কা থেকে বাড়ছে তেলের দাম।
আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে লাফিয়ে
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর পরপরই ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৭৯ ডলারের ঘর অতিক্রম করেছে—যা একদিনেই প্রায় ৩ শতাংশ বৃদ্ধি। মূলত হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে— এমন আশঙ্কায় সরবরাহ বিঘ্নের আতঙ্ক থেকেই দামের এই উল্লম্ফন।
বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল ও তেলজাত পণ্য সরবরাহ হয়। এটি বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। একইসঙ্গে এই জলপথ দিয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসেরও (এলএনজি) ২০ শতাংশ সরবরাহ হয়ে থাকে। ফলে এই পথ বন্ধ হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এর অভিঘাত হবে গভীর ও বহুমুখী।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব
বাংলাদেশ মূলত সৌদি আরব, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে অপরিশোধিত ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে থাকে। এই আমদানির পুরোটাই হরমুজ প্রণালির ওপর নির্ভরশীল। ফলে রুটটি বন্ধ হলে বাংলাদেশকে একযোগে মোকাবিলা করতে হতে পারে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্ন, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট এবং উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মতো পরিস্থিতি।
বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম যদি ৫ ডলার বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের বার্ষিক আমদানি ব্যয় বাড়বে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ কোটি ডলার। আর হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে এই ব্যয় দ্বিগুণ বা তারও বেশি হতে পারে।
বিদ্যুৎ, শিল্প ও পরিবহন খাতে চাপ
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক নির্ভর করে গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ওপর। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে সরাসরি ব্যাহত হবে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন, বাড়বে খরচ। সেক্ষেত্রে সরকারকে হয় বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হবে, না হয় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের কাঁধেই চাপ ফেলতে হবে। এর ফলশ্রুতিতে শিল্প উৎপাদন হ্রাস, লোডশেডিং বৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি ও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা
জ্বালানি ব্যয় বাড়লে সবার আগে তার প্রভাব পড়ে পরিবহন খাতে। ফলে কৃষিপণ্য, ভোগ্যপণ্য, ওষুধসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করে। খাদ্য ও অখাদ্য—উভয় ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতি ত্বরান্বিত হয়। যা ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকা দেশের ভোক্তাদের জন্য নতুন এক বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্স ঝুঁকিতে
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে এবং জ্বালানির দাম বেড়ে গেলে বাড়তি আমদানি ব্যয় সামাল দিতে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ পড়বে, বাড়বে বাণিজ্য ঘাটতি। একইসঙ্গে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টাকার মান আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয় ও অভ্যন্তরীণ মুদ্রাস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে।
এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি অভিবাসীর একটি বড় অংশ যুদ্ধ-আক্রান্ত অঞ্চলে কর্মরত। সংঘাত দীর্ঘায়িত হলে তাদের কর্মসংস্থানে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে, যা রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় ধাক্কা পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হরমুজ প্রণালি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হলেও বিশ্ববাজারে জ্বালানির মূল্য দ্রুত বাড়বে, যার অভিঘাত বাংলাদেশে বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশ। এখানকার বিদ্যুৎ, কৃষি, শিল্প ও পরিবহন খাত সরাসরি তেলের দামের ওপর নির্ভরশীল। তেলের দাম বাড়লে দ্রব্যমূল্য বাড়বে, রফতানি খাতে চাপ বাড়বে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমান ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
সরকারকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিকল্প জ্বালানি উৎস খুঁজে বের করা, এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ এবং রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় সতর্ক কৌশল নেওয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।’
মাত্র ৪৫ দিনের জ্বালানি মজুত
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত ঘনীভূত হয়ে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নিলে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ, পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) জ্বালানি তেলের মজুত সক্ষমতা মাত্র ১৪ লাখ টন, যা দেশের সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের চাহিদা পূরণে সক্ষম। এর বাইরে কোনও বিকল্প ব্যবস্থাপনা নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সরবরাহে সামান্য বিঘ্নও বাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হঠাৎ কমলেও তার সুফল বাংলাদেশে পৌঁছাতে সময় লাগে। আবার বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে তাৎক্ষণিকভাবে দেশে সংকট তৈরি হয়— যার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, গণপরিবহন, কৃষি ও শিল্প খাতে।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৩৪ শতাংশ এবং গণপরিবহনের ৯০ শতাংশই জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া, কৃষি খাতে সেচের একটি বড় অংশ পরিচালিত হয় ডিজেলচালিত সেচ পাম্পের মাধ্যমে। এই নির্ভরশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে পর্যাপ্ত জ্বালানি মজুত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে বাংলাদেশের ওপর যেসব সম্ভাব্য প্রভাব পড়তে পারে, তা হলো—
জ্বালানি সরবরাহে বিঘ্ন: হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে আমদানি ব্যয় ও পরিবহন সময় বেড়ে যাবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত: ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচও বাড়বে।
লোডশেডিং ও মূল্যস্ফীতি: ভর্তুকি না বাড়ালে লোডশেডিং এবং দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন অনিবার্য।
রফতানিতে ঝুঁকি: শিপমেন্ট দেরি হলে পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি।
রেমিট্যান্স হ্রাস: মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থায় শ্রমবাজার সংকুচিত হলে রেমিট্যান্স কমে আসতে পারে।
রিজার্ভে চাপ ও টাকার মান পতন: বাড়তি ডলার চাহিদায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাব এখনও সীমিত: ব্র্যাক-ইপিএল বিশ্লেষণ
চলমান ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের প্রভাব বাংলাদেশে এখনও সীমিত থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে কিছু নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছে শীর্ষস্থানীয় দেশীয় ব্রোকারেজ হাউজ ব্র্যাক-ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ।
এক বিশেষ বিশ্লেষণে সংস্থাটি জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতির প্রাথমিক প্রভাব ইতোমধ্যে শেয়ারবাজারে প্রতিফলিত হয়েছে। তবে সংঘাত আরও তীব্রতর হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের ওপর পুনরায় মুদ্রাস্ফীতির চাপ তৈরি হতে পারে এবং বৈদেশিক খাতের ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
ব্র্যাক-ইপিএল জানায়, হরমুজ প্রণালিতে যদি কোনও ধরনের বাধা সৃষ্টি হয়, কিংবা নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে যায়, তবে আন্তর্জাতিক জাহাজ ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রফতানির খরচও বেড়ে যাবে। এতে উৎপাদনমুখী শিল্প, বিশেষ করে রফতানিনির্ভর খাতগুলোর সরবরাহ চক্রে বিলম্ব সৃষ্টি হতে পারে।
সংস্থাটি আরও জানায়, উপসাগরীয় অঞ্চলের উত্তেজনা যদি রফতানি রুট পরিবর্তনে বাধ্য করে, তাহলে পোশাক খাতের রফতানি প্রতিযোগিতায় ক্ষতি হতে পারে। যদিও ইরানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব বেশি নয়, তাই ভারতের মতো চরম অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না।
ব্রোকারেজ হাউজটি পূর্ববর্তী সাতটি বৈশ্বিক ঘটনাবলির প্রভাব বিশ্লেষণ করে বলেছে, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার তুলনামূলক স্থিতিশীল থেকেছে।
২০২১ সালের ৫ মে মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে পাঁচ দিনের ব্যবধানে ডিএসইএক্স সূচক ২.৯ শতাংশ বা ১৬১.৬৭ পয়েন্ট বেড়ে যায়।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিন সূচক ১০৯.২৩ পয়েন্ট কমে যায় এবং পাঁচ দিনের ব্যবধানে মোট ১৪২.৯২ পয়েন্ট পতন ঘটে, যা সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে বিবেচিত।
২০২৩ সালে সুদান গৃহযুদ্ধ, ইসরায়েল-গাজা সংঘর্ষ এবং ভারতের মণিপুরে জাতিগত সহিংসতার মতো ঘটনা ডিএসই সূচকে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেনি।
চলতি বছর মে মাসে ভারত-পাকিস্তান ও চলতি জুনে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের সূচনায় সূচক প্রথমে কমলেও পরে পাঁচ দিনের ব্যবধানে ৩০ পয়েন্টের বেশি বেড়ে যায়।
বিশেষ করে গত ৭ মে ইন্দো-পাক সংঘাতে সূচক ১৪৯.৩১ পয়েন্ট পড়ে গেলেও পরবর্তী পাঁচ দিনে তা ৩৩.১৯ পয়েন্ট পুনরুদ্ধার করে।
ব্র্যাক ইপিএল’র ভাষ্যমতে, বর্তমান ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আরও তীব্রতর হলে বাজারে নতুন করে চাপ তৈরি হতে পারে। তবে এখন পর্যন্ত বাজার সতর্কভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
তারা আরও জানায়, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং চলমান বৈদেশিক অর্থায়নের মাধ্যমে কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হবে। তবে এই পরিস্থিতি ক্রমশ বিকাশমান এবং বিভিন্ন পক্ষের অবস্থান স্পষ্ট হলে পুরো প্রভাব নিরূপণ করা যাবে।