আজ ২১ ডিসেম্বর নাটোর হানাদার মুক্ত দিবস। ১৯৭১-এ নয় মাস যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ হানাদারমুক্ত হয়, কিন্তু নাটোরের মানুষ বিজয় উপভোগ করেন আজকের এই দিনে। এই দিন নাটোরের উত্তরা গণভবনে ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে নাটোর মুক্ত হয়। নাটোরের মানুষ আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে পালন করছে দিনটি। দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে শোভাযাত্রা ও সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। জেলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ড (সাবেক) ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড নাটোর এসব কর্মসূচির আয়োজন করেছে।
নাটোর পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি জানান, সোমবার (২১ ডিসেম্বর) সকালে নাটোর প্রেস ক্লাব চত্বর থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে মাদ্রাসামোড় এলাকায় স্বাধীনতা চত্বরে শেষ হবে। পরে সেখানে দিবসটির ওপর এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডাস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ সদর উপজেলা কমান্ডার আবুল হোসেন জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় নাটোর ছিল পাকিস্তান হানাদারদের ২নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। এখান থেকেই দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনা করতো পাক বাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর দেশের অন্যান্য স্থান শত্রুমুক্ত হলেও ২১ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত পুরো নাটোর ছিল তাদের দখলে। নাটোরের উত্তরা গণভবন ছাড়াও আনসার কোয়ার্টার, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজ, নাটোর রাজবাড়ি, পিটিআই, নাটোর মহারাজা জেএন উচ্চ বিদ্যালয়, ভকেশনাল স্কুল, দিঘাপতিয়া কালিবাড়ি ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ কার্যালয় ছিল পাকসেনাদের ঘাঁটি।
এ সময় পাক হানাদার বাহিনী নাটোর সদর উপজেলার ফুলবাগান, ছাতনী, দত্তপাড়া, মোহনপুর, লালবাজার, কাপুড়িয়াপট্টি, শুকলপট্টি, মল্লিকহাটি, বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়া ক্যাথলিক মিশন, গুরুদাসপুর উপজেলার নাড়িবাড়ি, সিংড়া উপজেলার হাতিয়ানদহ, কলম এবং লালপুর উপজেলার গোপালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল চত্বরসহ ২০টি স্থানে গণহত্যা চালায়। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি স্থান থেকে পাকসেনারা নাটোরের পিটিআই স্কুল, আনসার হল, রিক্রিয়েশন ক্লাব, এনএস সরকারি কলেজ, নাটোর রাজবাড়ি ও দিঘাপতিয়া উত্তরা গণভবনে (তৎকালীন গভর্নর হাউস) অবস্থান নেয়। পাকিস্তান বাহিনীর নাটোর ব্যারাক কমান্ডার পিএ ১৭০২ ব্রিগেডিয়ার নওয়াব আহমেদ আশরাফ ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার রঘুবীর সিং পান্নুর কাছে ২১ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম জানান, নাটোর মহকুমার শান্তি কমিটির সভাপতি ছিলেন কাঁচুউদ্দিন মোক্তার (কাঞ্চু) এবং সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার খান চৌধুরী (মধু)। আরও ছিলেন মুসলিম লীগ সদস্য দুদু মিয়া। তারা সকলেই নাটোর শহরে ছিলেন প্রভাবশালী। পাকবাহিনী আসার পর তাদের নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর, আলশামস ইত্যাদি পাকিস্তান সমর্থক স্থানীয় ও অবাঙালিরাও নাটোর সদরে ত্রাস সৃষ্টি করে। পাক সেনাদের পাশাপাশি তারাও লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ, হত্যা-নির্যাতন শুরু করে। তাদের এই দখলদারিত্ব ও প্রভাব বজায় ছিল যুদ্ধের শেষ অবধি। আর এ কারণেই মূলত নাটোরে পাক সেনাদের অবস্থান দুর্বল করা যায়নি এবং ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী মুক্ত হয়নি।
নাটোরের বীর প্রতীক সোলায়মান আলী দাবি করে বলেন, ‘পাকিস্তান বাহিনী নাটোরের যে সকল স্থানে গণহত্যা চালিয়েছিল তার কিছু স্থানে গণকবর ও শহীদ মিনার নির্মিত হলেও সেগুলোর যথোপযুক্ত তত্ত্বাবধান নেই। এখনও কোনও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়নি। তালিকা হয়নি গণকবরে শায়িত শহীদদের, সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়নি নাটোরের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস। শুধুমাত্র বিশেষ দিন পালন ও শহীদদের স্মরণের মধ্যেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ রাখলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ইতিহাস ভুলে যাবে।’ তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানান।