X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘বিনা অপরাধে’ সাত মাস কারাগারে কলেজছাত্র

তুহিনুল হক তুহিন, সিলেট
২২ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৪৩আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২২, ১৬:৪৬

সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা আবু সালেকের পরিবর্তে একেবারে বিনা দোষে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় তিন বছর জেল খেটেছেন টাঙ্গাইলের জাহালম। জাহালমের মতো বিনা অপরাধে সিলেটের কলেজছাত্র ইমন আহমদ (২৪) একটি হত্যা মামলায় দীর্ঘ সাত মাস ধরে কারাগারে রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

ইমন নগরীর কুয়ারপাড় এলাকার মৃত ময়না মিয়ার ছেলে। তিনি সিলেট সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের উড ওয়ার্কিং বিভাগের দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। এই ঘটনায় ইমন নামের আরেকজন জড়িত রয়েছে। যাকে সবাই ‘কালা ইমন’ নামে চেনেন। বিষয়টি জেনেও মামলার এজাহারে তার নাম অর্ন্তভুক্ত করা হয়। 

সূত্র জানায়, এজাহার অনুয়ায়ী চলতি বছরের ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেট নগরের ওসমানী মেডিক্যালের ৩নং গেটের সামনে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে বন্ধুদের হাতে খুন হন হোটেল শ্রমিক নাজিম উদ্দিন (২০)। সে সময় আহত হন শাহ আলম ও রুম্মান। এ ঘটনার রাতেই সিলেট মহানগর পুলিশের কোতয়ালি থানায় ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন নাজিমের বাবা নুর মিয়া।

মামলায় আসামিরা হলেন– নগরের মুন্সিপাড়ার জুয়েল আহমদ (১৮), রুমেল আহমদ (২১), ইমন (১৮), জনি (১৯), সানি (১৮), বনকলাপাড়ার সোহাগ (২১), রফিকুল (১৯), কুয়ারপাড়ের ইমন (২৪), বাগবাড়ির কবির (১৮) ও মোজাম্মেল (১৮)।

কলেজছাত্র ইমনের পরিবার জানায়, নাজিমকে হত্যা করার পরপরই সাধারণ জনতা জুয়েলকে আটক করে পুলিশে দেয়। সে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের নাম বলে। জড়িতদের মধ্যে একজনের নাম ইমন। সে নগরীর মুন্সিপাড়ার মামুন মিয়ার ছেলে। এলাকায় ‘কালা ইমন’ নামে পরিচিত। ঘটনার রাতে নিহতের বাবা নুর মিয়া আসামিদের নামসহ একটি এজাহার লিখিয়ে নিয়ে যান। পুলিশ তার এজাহার না নিয়ে অন্য একটি এজাহার তৈরি করে দেয়। সেখানে ৫ ও ৭ নম্বর আসামির নাম ইমন। ৫ নম্বর আসামি মুন্সিপাড়ার ইমনের (১৮) বাবা অজ্ঞাত এবং ৭ নম্বর আসামি কুয়ারপাড়ের ইমনের (২৪) পূর্ণ ঠিকানা রয়েছে। নুর মিয়ার সঙ্গে থানায় যাওয়া দুজন নিকট আত্মীয়ের একজন কুয়ারপাড়ের ইমনকে চেনেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বললে থানা হাজতে থাকা জুয়েলকে ডাকা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নুর মিয়ার সঙ্গের এক যুবক বলেন,  সে সময় কুয়ারপাড়ের ইমনের ছবি দেখানো হলে জুয়েল জানায়, ছবির এই তরুণকে সে চেনে না। হত্যাকাণ্ডের সময় তাদের সঙ্গে যে ইমন ছিল তার বাসা মুন্সিপাড়ায়। তাকে ‘কালা ইমন’ বলে ডাকা হয়। তখন পুলিশ বলে, ‘কে ছিল তা তদন্তে বের হবে।’

এদিকে ১৩ এপ্রিল জুয়েল সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল মোমেনের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে সে স্পষ্ট করে বলে, হত্যাকাণ্ডে তাদের সঙ্গে ছিল কালা ইমন। জুয়েলের মা পারভিন বেগমও জানান, কারাগারে থাকা ইমনকে জুয়েল চেনে না বলে তাকেও জানিয়েছে।

এর মধ্যে ১১ এপ্রিল র‌্যাব-৯ সোহাগ ও সানিকে গ্রেফতার করে কোতয়ালি থানায় হস্তান্তর করে। এই দুজনও কুয়ারপাড়ের ইমনকে চেনে না বলে পুলিশকে জানায় বলে জানান নুর মিয়ার সঙ্গে থানায় যাওয়া ওই যুবক। এরপর ১৪ এপ্রিল ইমনকে গ্রেফতার করে কোতয়ালি থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব-৯। ২৬ এপ্রিল দুদিনের রিমান্ড শেষে ইমনকে কারাগারে পাঠানো হয়। আর সোহাগ ও সানি আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে শুধু ‘ইমন' বললেও তারা জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে তাদের সঙ্গে ‘কালা ইমন’ ছিল। কারান্তরীণ কুয়ারপাড়ের ইমন ছিল না।

৩১ আগস্ট সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জকিগঞ্জের এক যুবক বলেন, ‘কারাগারের মেডিক্যালে চার জনের সঙ্গেই আমার কথা হয়। জুয়েল, সোহাগ ও সানি জানায়, কারাগারে থাকা ইমনকে তারা চেনে না। সে ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে ছিল না। ইমন এই খবরটি তার পরিবারের কাছে পৌঁছানোর জন্য অনুরোধ করেছে।’

বিনাদোষে কারাভোগের বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকেও জানায় ইমন। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আইনত আমাদের কিছুই করার নেই। তবু ঊর্ধ্বতন কেউ কারাগার পরিদর্শনে এলে ইমনের বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করবো।’

এ বিষয়ে ইমনের হবু শ্বশুর জেবুল আহমদ বলেন, ‘ঘটনার দিন ইফতারের পর আমার বাড়ি সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বলাউড়া এলাকার কসকালিকা গ্রামে আসে ইমন। রাত ১০টার দিকে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। অথচ এজাহারে বলা হয়েছে, খুনের ওই ঘটনা ঘটে রাত ৯টা ৩৫ মিনিটে। রমজানের পর আমার মেয়ের সঙ্গে ইমনের বিয়ের কথা ছিল। যদি ঘটনার সময় অন্য কোথাও থাকতো, তাহলে মামলা হলে মনকে বোঝানো যেত। নিজের চোখের সামনে থেকে গিয়ে ছেলেটা বিনা দোষে কত বড় বিপদে পড়লো।’

মামলার এজাহারনামীয় আসামি, জুয়েল, সোহাগ, সানি ও কুয়ারপাড়ের ইমন কারাগারে রয়েছেন।  মুন্সিপাড়ার ‘কালা ইমন’সহ ছয় জন পলাতক রয়েছে। ঘটনার ছয় মাস অতিবাহিত হলেও তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

মামলার বাদী নিহত নাজিম উদ্দিনের বাবা নুর মিয়া বলেন, ‘হয়তো শত্রুতা করে কেউ কুয়ারপাড়ের ইমনের নাম মামলায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।’ তিনি জানান, এখন বিষয়টি আদালতে বললে মামলার ক্ষতি হবে, এ জন্য তিনি বলবেন না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কিছু মানুষের জন্য এখন একটু বেকায়দায় আছি। নইলে আমরা আদালতে গিয়ে বলতাম কুয়ারপাড়ের ইমন আসামি না। আর আমরা কোনও আসামির নাম দিইনি। গ্রেফতার আসামি যাদের নাম বলেছে তাদেরই আসামি করা হয়েছে।’

ইমনের মা নুরজাহান বেগম বলেন, ‘ছয় মাস ধরে আমার নির্দোষ ছেলে জেলে বন্দি। যে বা যারা আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলায় জেলে ঢুকাইছে আমি তাদের বিচার চাই।’

কলেজছাত্র ইমনের আইনজীবী টিপুরঞ্জন দাশ বলেন, ‘এজাহারের ভাষ্যমতে তার কোনও অপরাধ নেই। ভিকটিমকে কোনও কিছু করার অভিযোগও নেই। তিন জন আসামি ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের একজন স্পষ্ট করে আসামির নাম ‌“কালা ইমন” বলছে। এজাহারে দুজন ইমন আছে। আমাদের কাছে সব ধরনের প্রমাণ আছে, এই ঘটনার সঙ্গে কুয়ারপাড়ের ইমনের কোনও সম্পৃক্ততা নেই। আমরা আদালতকে সেটি বলেছি।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও কোতয়ালি থানার লামাবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনর্চাজ এসআই এএইচএম রাশেদ ফজল বলেন, ‘তদন্তের সময়ে যা পেয়েছি তাই উল্লেখ করেছি। আমি মামলাটি থানায় বুঝিয়ে দিয়ে দু মাসের জন্য ট্রেনিংয়ে চলে এসেছি।’

কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী মাহমুদ বলেন, ‘বাদীর দেওয়া এজাহারেই মামলা রেকর্ড হয়েছে। নির্দোষ কেউ হত্যা মামলার আসামি হোক সেটি আমরাও চাই না। তদন্ত কর্মকর্তাকে ডেকে ওই আসামির বিষয়টি পুনরায় গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে বলবো।’

/এমএএ/
সম্পর্কিত
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচনে পলকের হস্তক্ষেপ ঠেকাতে হাইকোর্টে রিট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
সর্বশেষ খবর
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!