X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্বাস আর বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা

খুলনা প্রতিনিধি
২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৫০আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৫০

সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকি পল্লীতে অবস্থান করছেন প্রায় ২৫ হাজার জেলে। তবে সেখানে রয়েছে সুপেয় পানি, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাসহ নানা সমস্যা। বন বিভাগের আশ্বাসের পরও মেলেনি কাঙ্ক্ষিত সেবা। এ অবস্থায় পানির চাহিদা মেটাতে ভরসা কুয়ার পানি। আর অসুস্থ হলে ফার্মেসির ওষুধই এসব জেলের সম্বল। অভিযোগ জেলেদের, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেয়া হলেও এ সমস্যা সমাধানে নেই কোনও উদ্যোগ। এদিকে, সুপেয় পানি, চিকিৎসা ও আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে সুন্দরবন বিভাগের কর্মকর্তারা। আর জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফাঁড়ি স্থাপনের কথা জানিয়েছে নৌ-পুলিশ।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন সুন্দরবনের দুবলার চর, আলোর কোল, শ্যালার চর, নারকেল বাড়িয়া, মাঝের কেল্লা, অফিসকেল্লাসহ কয়েকটি চরে প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত পাঁচ মাস চলে শুঁটকি আহরণ। সুন্দরবনে শুঁটকি আহরণ মৌসুমে এ সব চরে বাঁশ, কাঠ, ছন ও পলিথিন দিয়ে ছাপড়া ঘর তৈরি করেন জেলেরা। প্রতি বছর শুঁটকি মৌসুমে কমপক্ষে ২০ থেকে ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করেন সুন্দরবনের এসব চরে। গত ২০২০-২১ অর্থ বছরে শুঁটকি আহরণ থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে চার কোটি ১৮ লাখ টাকা। আর চলতি ২০২১-২২ অর্থ বছর সাড়ে চার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

জেলেদের অভিযোগ, বছরের এই পাঁচ মাস জীবিকার তাগিদে মৎস্য আহরণ কাজে নিয়োজিত জেলেদের সুপেয় পানির অভাব, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা, ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সুপেয় পানির অভাবে নানান রোগে আক্রান্ত হলেও মেলেনা চিকিৎসা সেবা। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে নেই পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র।

শুঁটকি ব্যবসায়ী ও জেলেরা জানান, বন বিভাগের আশ্বাসের ওপর নির্ভর কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর। তবুও মিলছে না সুপেয় পানি, আশ্রয়কেন্দ্র ও চিকিৎসা সেবা। তবে এই আশ্বাস আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার বাসিন্দা শুঁটকি ব্যবসায়ী মুজিবর রহমান বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে ৪৭ বছর ধরে সুন্দরবনের এই শুঁটকি পল্লীতে মাছ আহরণ ও এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আছি। নভেম্বর থেকে মার্চ- এই পাঁচ মাস শুঁটকি মৌসুম। বন বিভাগকে রাজস্ব দিয়ে আমাদের এখানে আসতে হয়। শুধু শুঁটকি মৌসুমে বন বিভাগ জেলে বহরদারদের কাছ থেকে আদায় করে কোটি টাকার রাজস্ব। তবুও এখানকার জেলে ও ব্যবসায়ীদের খাবার পানি, চিৎকিসা সেবাসহ নানা সমস্যায় পড়তে হয়।’

আশ্বাস আর বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা

তিনি আরও বলেন, ‘দুর্গম হওয়ায় এখানে কোনও জেলে বা ব্যবসায়ী রোগে আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিৎকিসা সেবা পান না। শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় অনেক সময় পৌঁছতে পৌঁছতে মারা যান অনেকে। কিছুদিন আগে সাপের কামড়ে চোখের সামনে এক জেলে মারা গেছেন। আমরা দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি।’

পাইকগাছা উপজেলার আরেক জেলে তপন দাস বলেন, ‘খাবার পানি বলতে চরে দুটি পুকুর ও ১৩টি পানির কুয়া রয়েছে। এই কুয়াগুলোর মধ্যে ১০টির পানি ব্যবহার অনুপযোগী। তিনটি কুয়া থেকে আমরা পানি সংগ্রহ করি। সেগুলোতে অধিকাংশ সময় বিভিন্ন পোকা-মাকড় ও ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। তাই পানি সংগ্রহ করে ছেঁকে ও ফিটকেরি দিয়ে খেয়ে থাকি। পুকুর দুটির পাড় ভেঙে সাগরের লোনা পানি ঢুকে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে বাঁচতে নেই আশ্রয়কেন্দ্র। পাঁচটি সাইক্লোন শেল্টার আছে। তা আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ হয়নি।’

রামপাল উপজেলার বাসিন্দা জেলে জামাল মোল্লা বলেন, ‘সুন্দরবনের এই চরগুলোতে চট্টগ্রাম, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা, বরগুনা, বাগেরহাট ও খুলনাসহ বিভিন্ন জেলার জেলেরা আসেন। সরকার এখান থেকে রাজস্ব আদায় করে। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা সুযোগ-সুবিধা পাই না। বছরের পর বছর আমরা শুধু আশ্বাসই পাই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।’

দুবলা ফিশারম্যান গ্রুপের সভাপতি কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দেশের শুঁটকির চাহিদার ৮০ ভাগ আসে দুবলা চর থেকে। এই শুঁটকি মৌসুম ঘিরে এখানে প্রায় ২৫ হাজার জেলে অবস্থান করে। এখান থেকেই বনবিভাগ কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় রাজস্ব দিলেও কোন ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায় না জেলেরা। এ ছাড়া গত বছরের তুলনায় এ বছর বন বিভাগ রাজস্ব নির্ধারণ হয়েছে বেশি।’

আশ্বাস আর বিশ্বাস করতে পারছেন না তারা

তিনি বলেন, ‘এখানে খাবার পানির অভাব রয়েছে। যা আছে তাও ছেঁকে ও বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করে খেতে হয়। এই পানি খেয়ে ডায়রিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জেলেরা। কোনও চিৎকিসা পায় না তারা। এখানে কিছু অস্থায়ী ওষুধের দোকান আছে, চিকিৎসার জন্য তারাই শেষ ভরসা। ঝড়ের সময় বাধ্য হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সাইক্লোন শেল্টারে আবার জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় ভারতীয় জেলেদের আক্রমণের শিকার হয় জেলেরা। তারা জেলেদের জাল ও মাছ লুটে নেয়। এদের ঠেকানের জন্যও নেই কার্যকর উদ্যোগ। সরকারের কাছে চর অঞ্চলে খাবার পানির ব্যবস্থা, ভাসমান হাসপাতাল, সাইক্লোন শেল্টার ও জেলেদের নিরাপত্তার জন্য ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানাচ্ছি।’

অতিরিক্ত আইজি ও নৌ-পুলিশ প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জীবিকার তাগিদে পরিবার-পরিজন ছেড়ে জেলেরা সুন্দরবনে আসেন। পাঁচ মাস দুবলার চর থেকে বিপুল পরিমাণ শুঁটকি আহরণ হয়। যা দেশ-বিদেশে বিক্রি হয়। জেলেদের এই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সুন্দরবন ও জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দুবলার চরের আলোর কোলে একটি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে জায়গা নির্ধারণ করতে জেলে ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে।’

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘১ নভেম্বর থেকে ১৫টি বহরদারের আওতায় জেলেরা সুন্দরবনের বিভিন্ন চরে শুঁটকি আহরণের জন্য অবস্থান করছে। যেহেতু জেলেরা বন বিভাগকে রাজস্ব দিচ্ছে, পাঁচ মাস সেখানে অবস্থান করছে, সেখানে তাদের জন্য সুপেয় পানি, চিৎকিসা সেবা ও আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন। বন বিভাগের একটি ইকোট্যুরিজম প্রকল্প আছে, ওই প্রকল্পের আওতায় দুবলার জেলেদের পানির চাহিদা মেটানোর জন্য একটি নতুন পুকুর খনন করে দিয়েছি। এ ছাড়া একটি পুরাতন পুকুর সংস্কার করে দেওয়া হয়েছে। এতে যদি জেলেদের পানির চাহিদা পূরণ না হয়, সেক্ষেত্রে বন বিভাগের সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় সেখানে আরেকটি পুকুর খনন করে দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘সেখানে জেলেদের চিৎকিসা সেবার প্রয়োজন আছে। কারণ দুর্গম এলাকা হওয়ায় জরুরি প্রয়োজনে চিৎকিসা সেবা নিতে জেলেদের শহরে আসতে অনেক সময় লাগে। এ জন্য সেখানে একটি ভাসমান হাসপাতাল তৈরির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি সেখানে ডাক্তারের ব্যবস্থা করার জন্য বাগেরহাট সিভিল সার্জনকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী পাঁচটি সাইক্লোন শেল্টার ভেঙে নতুন করে পাঁচটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণের জন্য চিঠি লেখা হয়েছে।’

/এফআর/
সম্পর্কিত
তীব্র গরমেও শীতল করমজল!
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
মৎস্যঘের থেকে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো কুমির উদ্ধার
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!