X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

অবৈধ জাল দিয়ে পোনানিধন, বিলুপ্তির পথে নানা প্রজাতির মাছ

সুমন সিকদার, বরগুনা
২৫ আগস্ট ২০২১, ২০:৪২আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২১, ২০:৪২

বরগুনাসহ দক্ষিণের উপকূলীয় এলাকার নদ-নদীতে অবৈধ জাল ফেলে মাছ শিকারের মহোৎসব চলছে। ছোট ফাঁসের গড়া জাল, বেড় জাল, ভাসা জাল ও বেহুন্দি জাল, কারেন্ট জালসহ নানা ধরনের অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন জেলেরা। এসব জালে ধরা পড়ে প্রতিদিনই অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা নিধন হচ্ছে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অবাধে মাছের পোনা নিধনযজ্ঞ বন্ধ না হলে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বরগুনার প্রধান নদ-নদী পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর। এছাড়াও এসব নদীর শাখা-প্রশাখায় বেশ কিছু প্রবাহমান খাল রয়েছে। এ তিনটি নদ-নদী ও বেশ কিছু খাল ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে খুঁটি গেড়ে ছোট ফাঁসের জাল পেতে অবাধে মাছ ধরা হচ্ছে। বরগুনা সদরের বড়ইতলা ফেরিঘাটের দক্ষিণ পাশে সন্ধ্যার পরে চলে পোনা নিধনের মহোৎসব। প্রায় অর্ধশত জেলে বাগদা-গলদা চিংড়ি, পোয়া মাছ ধরার নামে নিধন করছে বিভিন্ন প্রজাতির পোনা মাছ। প্রশাসনের নাকের ডগায় পোনানিধনযজ্ঞ অনেকটা ওপেনসিক্রেট হলেও সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার। বরগুনা সদরের চালিতাতলী থেকে সোনাতলা পর্যন্ত পায়রা নদীর দুই পাড়, বিষখালী নদীর বড়ইতলা-নলী থেকে গোড়াপদ্মা পর্যন্ত, বদরখালির কুমড়াখালী থেকে গুলিশাখালী, মাঝের চরের চারদিকে, পাথরঘাটার ছোনবুনিয়া থেকে ছোটপাথরঘাটা, বেতাগী ও বামনা উপজেলা বিভিন্ন এলাকার নদী তীরবর্তী চর ও তালতলী থেকে তেঁতুলবাড়িয়া হয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনা পর্যন্ত এবং বলেশ্বর নদের মোহনা হয়ে পশ্চিমে চরদুয়ানি পর্যন্ত এলাকাজুড়ে এসব জাল পেতে রাখা হয়। সন্ধ্যা রাত থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে পোনা নিধনের মহোৎসব।

অবৈধ জাল দিয়ে পোনানিধন, বিলুপ্তির পথে নানা প্রজাতির মাছ বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়নের বড়ইতলা এলাকায় দেখা যায়, বিশখালী নদীতে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৩৫ জন জেলে বেহেন্দি, বেড় ও গড়া জাল পেতে দিয়ে মাছ ধরছেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে জেলেরা মাছ নিয়ে তীরে আসেন। এ সময় দেখা যায়, পোয়া, টেংরা, গুলিশাসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পাশাপাশি অসংখ্য মাছের পোনা আটকা পড়ছে। জাটকার চেয়েও ছোট সাইজের ইলিশ, রিঠা, আইড়, পাঙাস, কাচকি, চাপিলা, চাপিদা, ভাটা, বায়লা, পুঁটি, বাইম ও চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ছোট ফাঁসের এসব জালে ধরা পড়ছে। ক্ষুদ্রাকৃতির এসব পোনা ‘গুঁড়া মাছ’ হিসেবে কেজি দরে বাজারে বিক্রি হচ্ছে।

বন বিভাগের হরিণঘাটা লালদিয়ার চর এলাকার বিষখালী নদীতে দেখা যায়, বেহেন্দি জাল দিয়ে মাছ ধরছেন অনেকে। সিদ্দিকুর রহমান নামে এক জেলে বলেন, ‘সবাই ধরে, আমিও হেইতে ধরি। কেউ তো কিছু কয় না। আমাগো এলাকায় এই রহম তিনশ’র বেশি নৌকায় ভাসা জাল দিয়া মাছ ধরে।’ সেখানে আরও কয়েকজন জেলে জানান, জালে জাটকা, পোয়া, তপসি, টেংরাসহ অন্য প্রজাতির অনেক মাছ আর পোনা ধরা পড়ে। যেসব পোনা বিক্রি করে লাভ নেই, তারা সেগুলো ফেলে দেন। বলেশ্বর নদের মোহনায় হরিণঘাটা হয়ে উত্তরে চরদুয়ানি পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার জুড়ে বাঁশের খুঁটি গেড়ে ভাসা ও বেড়জাল পেতে রাখা হয়। পাশাপাশি স্রোতের মুখে বেহেন্দি জাল পেতেও মাছ ধরছেন জেলেরা। এ এলাকা হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনের আওতাভুক্ত। এছাড়াও তালতলী উপজেলার সোনাকাটা, শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত, নিশানবাড়িয়া ও টেংরাগীরি বনাঞ্চলের তীর ঘেঁষে জেলেরা একইভাবে মাছ শিকার করেন।

অবৈধ জাল দিয়ে পোনানিধন, বিলুপ্তির পথে নানা প্রজাতির মাছ উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সরকারের বিধিনিষেধ মেনে সমুদ্রে ও নদ-নদীতে ৬৫ দিন ও প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন মাছ শিকার বন্ধ রাখি। কিন্তু অবৈধ বেহুন্দি, চরগড়া ও ছোট ফাঁসের কারেন্ট জালে উপকূল সয়লাব। তাদের কারণে সরকারি নিষেধাজ্ঞার পুরোপুরিভাবে সুফল বয়ে আনে না। এসব জাল বন্ধে আমরা একাধিকবার মৎস্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অপ্রতিরোধ্য এসব জেলেদের কারণে উপকূলে মাছের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হলেও কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেই।’

উপকূলীয় ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘একশ্রেণির জেলে বছরব্যাপী অবৈধ জাল অবাধে ব্যবহার করে মাছের পোনা নিধন করে আসছে। আমরা বারবার মৎস্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করেও প্রতিকার পাইনি। এভাবে শিকার চলতে থাকলে উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছের বংশ শেষ হয়ে যাবে, কমে যাবে সামুদ্রিক মাছ।’

অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট এলাকার বন বিভাগের রেঞ্চ ও বিট কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে ‘মাসোহারা’ দিয়েই জেলেরা এসব অবৈধ জাল ব্যবহার করে মাছ শিকার করে আসছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের একাধিক জেলে জানান, অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকারের জন্য তারা প্রত্যেক জেলে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে দেন। এ ছাড়াও বরগুনা সদরের নলটোনা ইউনিয়নে সোনাতল, গোড়াপদ্মা ও নিশানবাড়িয়া এলাকার বেশ কয়েকজন জেলে জানান, স্থানীয় বন বিভাগের সদস্যদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে তারা মাছ শিকার করছেন। গড়াজাল দিয়ে মাছ ধরতে দুই সপ্তাহ পর পর বন বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। বরগুনা সদরের ঢলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য জেলেদের কাছ থেকে টাকা তুলে বন বিভাগের কর্মকর্তাকে বুঝিয়ে দেন। ঠিক একইভাবে অন্য এলাকার জেলেরাও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যস্থতায় বন বিভাগকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে থাকেন।

অবৈধ জাল দিয়ে পোনানিধন, বিলুপ্তির পথে নানা প্রজাতির মাছ অভিযোগ প্রসঙ্গে বন বিভাগ বরগুনা জেলার দায়িত্বে থাকা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘মাত্র এক মাস হয়েছে আমি এখানে যোগদান করেছি। বন বিভাগের কোনও কর্মকর্তা মাসোহারা নেন বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে রেঞ্জ কর্মকর্তারে সঙ্গে আমি বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো। যদি কেউ মাসোহারা নিয়ে থাকেন তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানান, এসব জাল উচ্ছেদের ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তাকে জানানো হবে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘অবৈধ জাল পাতা বন্ধে মৎস্য বিভাগ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু জাল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। এছাড়াও স্থানীয় জেলেদের নিয়ে সচেতনতামূলক বৈঠক করে আসছি। তবে করোনার কারণে কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত আছে। আমরা শিগগিরই অভিযান আরও জোরদার করবো।’

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ