সকল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা, সাংবাদিকতা ও কৃষি খাতসহ দেশের প্রায় প্রতিটি খাতে নিরলস কাজ করছেন। এর ব্যতিক্রম নয় চাঁদপুর জেলাও।
জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা একজন নারী। এমনকি চাঁদপুরের আটটি উপজেলার মধ্যে পাঁচটিতেই নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) দায়িত্ব পালন করছেন পাঁচ নারী। বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব চালকের আসনে রয়েছেন আরও অনেকে।
সরকারি বিভিন্ন দফতরে থাকা নারী কর্মকর্তারা বলছেন, সকল বাধা অতিক্রম করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই পিছিয়ে নেই নারীরাও। মেয়েদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই নারীরা আরও এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ডিসি ছাড়াও চাঁদপুর জেলা প্রশাসনে রয়েছেন এক ঝাঁক নারী কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) রাশেদা আক্তার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (জেনারেল সার্টিফিকেট শাখা ও স্ট্যাম্প অবমূল্যায়ন সেল, জাটকা শাখা) শারমিন আক্তার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (শিক্ষা শাখা) আখতার জাহান সাথী, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সেলিনা আক্তার, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (তথ্য প্রদান ইউনিট) আবিদা সিফাত, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (অভিযোগ ও তদন্ত সেল) রেশমা খাতুন, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) রিক্তা খাতুন, সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (গোপনীয় শাখা) দেবযানী কর।
পাঁচটি উপজেলা প্রশাসন সামলাচ্ছেন চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ, ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলী হরি, হাজীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার, মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা হক, শাহরাস্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিরীন আক্তার।
এছাড়া করোনাকালে স্বাস্থ্য বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুনাম কুড়িয়েছেন বেশ কয়েকজন নারী চিকিৎসক। তাদের মধ্যে একজন চাঁদপুর ২৫০ শয্যার সরকারি জেনারেল হাসপাতালে সহকারী পরিচালক ডা. সাজেদা বেগম পলিন। তিনি করোনার ভয়াবহতার সময় রোগী সেবায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু পরিবার অনেক ভালো সহযোগিতা করছে। আবার অনেক পরিবারের মেয়েরা এখনও পিছিয়ে রয়েছে। কারণ, এখনও অনেক পরিবার অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। হাসপাতালে অনেক রোগী আসে, যাদের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছে। অর্ধেকেরও বেশি এমন রোগী আমরা পাই। এটি নারীর প্রতি অসমতার একটি প্রমাণ। তাই সকল পর্যায়ের নারীকেই অধিকার দেওয়া উচিত।
ডা. সাজেদা বেগম বলেন, নারীদের অগ্রযাত্রায় প্রধান সমস্যা, অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি। ছেলেকে অনেক পড়াবো, মেয়েকে কম পড়ালেখা করাবো, মেয়ে বের হলে রাস্তায় সমস্যা হবে, বাইরে মেয়েরা কীভাবে একা কাজ করবে—এ ধরনের নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের সমাজ এখনও পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেনি। এছাড়া অর্থনৈতিক কিছু ব্যাপার আছে। একজন বাবার উপার্জন কম থাকলে ছেলেকে পড়ান, মেয়েকে পড়াতে চান না।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে পরিবার থেকে শতভাগ সাপোর্ট পাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে প্রচুর সময় দিতে পেরেছি। তবে আমাকে সব সময় পুরুষ সহকর্মীদের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়। মন থেকে কাজ করলে অনেকের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কিছু বাধা থাকলেও অতিক্রম করা যায়। সুতরাং আগ্রহ নিয়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সানজিদা শাহনাজ বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে নারীদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কারণ, দেশ এগিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নারীরাও এগিয়ে যাচ্ছেন। বিগত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মেয়েদের পাসের হার ভালো।
তিনি বলেন, আমি যে কর্মপরিবেশে আছি, সেখানে নারী হিসেবে প্রতিবন্ধকতা খুব একটা নেই। এখানে নারী-পুরুষ সবাই সমান মর্যাদা পায়।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলি হরি বলেন, বর্তমান সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে। পারিবারিক বা কর্মক্ষেত্রে আমি তেমন কোনও বাধার মুখোমুখি হইনি বলেই কাজ করতে পারছি। নারীর অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে। সবকিছু একবারে পরিবর্তন করা যায় না। আশা করি, সামনের দিনগুলোতে নারীরা আরও এগিয়ে যাবেন।
এদিকে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদানের পর সরকারের শত শত কোটি টাকা রক্ষা, সরকারি সম্পদ রক্ষায় পদক্ষেপ এবং সরকারি সেবা দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছেন অঞ্জনা খান মজলিশ।
নারী দিবস উপলক্ষে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা। আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাসাধ্য ভালোভাবে পালন করাই আমার কাজ। আমি নারী কিংবা পুরুষ সেটা কোনও বিষয় না। আমি একজন নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কোনও বাধা সৃষ্টি করে না।
অঞ্জনা খান বলেন, গত ৫০ বছরে দেশে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নানামুখী উদ্যোগ নেওয়ায় নারীরা এখন প্রশাসনসহ সকল ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। তাই নারীদের আরও অগ্রগতি হওয়া প্রয়োজন। সবাই শিক্ষিত হওয়া এবং তাদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। যদি নারীরা শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হয় তখনই সে তার অধিকার ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন হবে। তখন নারী নির্যাতন কমে আসবে। দেশ আরও এগিয়ে যাবে। যদিও এখনও কিছু ক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রার ব্যাহত করছে কুসংস্কারবোধ, অসচেতনতা এবং শিক্ষার অভাব।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে প্রতিটি পরিবারের কাছে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটি পরিবারে যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তখন সে মেয়ে নাকি ছেলে না দেখে সন্তান হিসেবে দেখা উচিত। আর সেই সন্তানকে বাবা-মায়ের উচিত সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে সচেতন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
