X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আয়াতকে হত্যার পর যার কাছে সব বলেছিল আবির

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ২২:০৫আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২২, ২২:১৮

২০ লাখ টাকা মুক্তিপণের লোভে শিশু আলিনা ইসলাম আয়াতকে (৫) অপহরণ করেছিল আবির আলী। এই শিশুকে অপহরণ করে খুনের পরিকল্পনা করে দেড় মাস আগে। বিষয়টি আবির জানিয়েছিল হোটেলে কাজ করা মো. হাসিব নামে তার এক বন্ধুকে। আয়াতকে অপহরণের পর খুনের বিষয়টি জানার পরও তথ্য গোপন করেছিল ওই যুবক।

মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানা এলাকার বাসার সামনে থেকে হাসিবকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার আদালতে সোপর্দ করার পর সে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমানের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় এই যুবক। সে নগরের ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা নয়ারহাট সাইফুল কলোনির মৃত মো. দুলালের ছেলে এবং নয়াহাট এলাকার ‘ভাই ভাই’ হোটেলে কাজ করতো।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্র জানায়, আদালতে জবানবন্দিতে হাসিব উল্লেখ করেছে, ‘আমার কর্মস্থল ভাই ভাই হোটেলের পাশে মঞ্জুর বিল্ডিং। আবির আগে মঞ্জুর বিল্ডিংয়ে থাকতো। আমরা ছোটবেলা থেকে এই এলাকায় থাকি। সে বয়সে আমার বড়। তাই তাকে আমি ভাই বলে ডাকতাম। আবিরের বাবা-মা ৫-৬ মাস ধরে আলাদা থাকে। আবির তার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে আকমল আলী মার্কেট রোড এলাকায় থাকে’।

‘অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে একদিন আবিরের সঙ্গে আমি নেভি গেটের নালার পাশের দেয়ালে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। তখন আবির আমাকে বলে, মঞ্জু বিল্ডিংয়ের মঞ্জুর নাতনি আয়াতকে অপহরণ করে মেরে ফেলবে, আর তার দাদার কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা নেবে। আবির আমাকেও বলে সঙ্গে থাকার জন্য। বলি, আমি এসবে নাই। এ কথা বলে আমি চলে আসি। সে আমাকে বলে, কাউকে যেন কিছু না বলি। আমিও কাউকে এ কথা বলিনি।’

‘গত ১৫ নভেম্বর ভাই ভাই হোটেলে আবির তার বন্ধু রবিনসহ যায়। আবির গরুর মাংস দিয়ে ভাত খায়। রবিন ভাত খায়নি। বিকাল প্রায় ৫টার সময় আমি ভাই ভাই হোটেলে থাকাবস্থায় দেখি লোকজন ছোটাছুটি করছে। একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করি কী হয়েছে? সে বলে, আয়াতকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হোটেলে কাজ শেষে বের হয়ে মঞ্জুর বিল্ডিংয়ের রাস্তার বিপরীত পাশে আইয়ুব বিল্ডিংয়ের সামনে আবিরের সঙ্গে আমার দেখা হয়। আমরা দুজন লেবার কলোনির দিকে আয়াতকে খুঁজতে যাই। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি, আয়াতকে আপনি কিছু করেছেন? সে আমাকে বলে, আয়াতকে কিডন্যাপ করে মেরে ফেলেছে। লাশ ওর বাসা আকমল আলী পকেট গেটে আছে। আয়াতের দাদার কাছে দুই একদিন পর মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা চাইবে।’

‘সে আমাকে বলে টাকা নেওয়ার সময় সঙ্গে থাকতে। তাহলে আমাকেও কিছু টাকা দেবে। আয়াতকে মেরে ফেলেছে শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি তার কথায় রাজি হইনি। আমার বাসার দিকে চলে যাই। ভয়ে আমি কাউকে কিছু বলিনি। কারণ, আমার মনে হচ্ছিল এসব বললে মানুষ আমাকে সন্দেহ করবে। এরপর আমি আমার মতো করে দিন কাটাচ্ছিলাম।’

হাসিব আদালতে আরও বলেন, ‘আয়াতকে মেরে ফেলার ঘটনা সবাইকে বলে দিলে হয়তো তার লাশ টুকরো করার আগে পাওয়া যেতো। আমি ভয়ে কাউকে বলিনি। পরে আমি শুনেছি, আবির আয়াতের লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দিয়েছে।’

পিবিআই মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসিব পেশায় হোটেল কর্মচারী। সে আবিরের বন্ধু। আয়াতকে অপহরণের পর খুনের বিষয়টি হাসিব জানতো। যা আমরা তদন্তে পেয়েছি। তথ্য গোপনের অভিযোগে মঙ্গলবার তাকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার আদালতে সোপর্দ করলে হাসিব ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।’

এর আগে, গত শনিবার (৩ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল দেবের আদালতে আবির আলী ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে। সেখানে উল্লেখ করে, দেড় মাস আগে আয়াতকে গুম করে তার পরিবারের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সে। এর আগেও কয়েকবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। বাসার আশপাশে লোকজন থাকায় কিছু করতে পারেননি।

আবির আদালতে দাবি করে, মা-বাবার খারাপ সম্পর্ক, মায়ের চাকরি চলে যাওয়া, নিজে কিছু করতে না পারা এবং হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ইচ্ছা থেকে সে এমনটা করেছে। ২০ লাখ টাকা দিয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিনে ভাড়া দেওয়ার চিন্তা করে। তাই আয়াতকে খুন করে এ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা করে।

ভারতীয় সিরিয়াল ক্রাইম প্যাট্রল ও সিআইডি দেখে আয়াতকে খুনের ঘটনা রপ্ত করার কথাও জবানবন্দিতে স্বীকার করে সে। জানায়, আয়াতকে ঘটনার দিন (১৫ নভেম্বর) মক্তবে পড়তে যাওয়ার সময় তাদের ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। এরপর গলাটিপে ও মুখে হিজাব পেঁচিয়ে হত্যা করে। পরে বাসার অন্যান্য মালামালের সঙ্গে একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে আকমল আলী সড়কের মায়ের ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। এ সময় আরিবের মা বাসায় ছিলেন না।

গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আবিরের মা-বাবা আলাদা থাকছেন। আবির লাশটি মায়ের বাসায় শৌচাগারের ওপর জিনিসপত্র রাখার জায়গায় লুকিয়ে রাখে। সন্ধ্যার পর সে আয়াতদের বাসায় গিয়ে তাকে খুঁজতে থাকে। এরপর বাসায় ফিরে আয়াতকে পাওয়া যাচ্ছে না জানিয়ে মা ও বোনকে আয়াতদের বাসায় পাঠায়। এরপর সে লাশটিকে ছয় টুকরো করে পলিথিনে ভরে রাখে। পরদিন নগরের বন্দরটিলা বে-টার্মিনাল সাইনবোর্ড এলাকায় ও আকমল আলী ঘাট স্লুইসগেট এলাকায় খণ্ডিত লাশ ফেলে দেয়।

আয়াত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এর আগে পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেছিলেন, ‘মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণ করে তাদের সাবেক ভাড়াটিয়া আবির আলী। গত ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানাধীন বন্দরটিলা নয়াহাট বিদ্যুৎ অফিস এলাকার মসজিদের পাশ থেকে আরবি পড়তে যাওয়ার সময় আয়াতকে অপহরণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে লাশ আকমল আলী সড়কের নিজ বাসায় নিয়ে ছয় টুকরো করে আবির। লাশের টুকরো দুটি বস্তায় করে পতেঙ্গা বেড়িবাঁধ এলাকায় বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয় সে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন আয়াতকে না পেয়ে তার বাবা ইপিজেড থানায় নিখোঁজের জিডি করেন। জিডির ছায়াতদন্ত করে পিবিআই। এ ঘটনায় সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে আবিরকে বৃহস্পতিবার রাতে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর সে পিবিআইকে এসব তথ্য দিয়েছে।’

এদিকে, ২৯ নভেম্বর ভোরে গ্রেফতার করা হয় ঘাতক আবির আলীর বাবা আজমল আলী, মা আলো বেগম ও বোন আঁখি আকতারকে। এদিকে, আবির আলীর দেওয়া তথ্যে নিহত আয়াতের লাশের তিনটি খণ্ডিত অংশ উদ্ধার করা হয়। পরে সেগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়।

/এফআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পিবিআইয়ের প্রতিবেদন গ্রহণ, পরীমনিকে আদালতে হাজির হতে সমন জারি
আত্মসমর্পণের পর কারাগারে  বিএনপি নেতা হাবিব-দীপক
পরীমনির বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ সত্য’, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আবেদন
সর্বশেষ খবর
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ