নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নে নুরজাহান বেগম (৫৮) নামে এক নারীকে পাঁচ টুকরো করে হত্যার ঘটনায় ছেলেসহ সাত জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে প্রত্যেক আসামিকে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) দুপুর ১২টায় নোয়াখালী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক নিলুফার সুলতানা এ রায় দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন ওই ইউনিয়নের জাহাজমারা গ্রামের নিহতের ছেলে হুমায়ুন কবির (৩২), তার সহযোগী একই গ্রামের মিলন মাঝির ছেলে নিরব (২৬), নূর আলমের ছেলে কসাই নুর ইসলাম (৩২), দুলাল মাঝির ছেলে কালাম ওরফে মামুন (২৮), মমিন উল্যার ছেলে মো. ইসমাইল (৩৫), হারুনের ছেলে মিলাদ হোসেন সুমন (২৮) এবং মারফত উল্যার ছেলে আব্দুল হামিদ (৩৫)। রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন তারা।
সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট গুলজার আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘এই মামলায় ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। আসামিদের মধ্যে পাঁচ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর মধ্যে নিহতের ছেলের বন্ধু নিরব ও কসাই নুর ইসলামের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ধারালো চাপাতি, বালিশ, কোদাল ও নিহতের ব্যবহৃত কাপড় উদ্ধার করা হয়।’
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর বিকালে জাহাজমারা গ্রামের একটি ধানক্ষেত থেকে নুরজাহান বেগমের খণ্ডিত পাঁচ টুকরো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে হুমায়ুন কবির বাদী হয়ে চরজব্বর থানায় মামলা করেন। মামলা তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে হুমায়ুনের জড়িত থাকার প্রমাণ পায় পুলিশ। হুমায়ুন তার ছয় সহযোগীকে নিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে হুমায়ুন জানান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এরপর তার ছয় সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়।
মামলার এজাহারের বরাত দিয়ে জেলা গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক জাকির হোসেন বলেন, নুরজাহান বেগমের প্রথম সংসারে বেলাল নামে এক ছেলে রয়েছেন। পরের সংসারে হুমায়ুন কবির নামে আরেক ছেলে রয়েছেন। বেলাল তার মাকে জিম্মায় রেখে কয়েকজনের কাছ থেকে চার লাখ টাকা ঋণ নেন। ওই ঋণ রেখে দেড় বছর আগে মারা যান বেলাল। পরে ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য তার সৎভাই হুমায়ুনকে চাপ দিকে থাকেন পাওনাদাররা। হুমায়ুন বিষয়টি তার মাকে জানালে ১৩ শতাংশ জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বলেন মা। তবে মায়ের ১৪ শতাংশ ও বেলালের স্ত্রীর ১০ শতাংশ জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে বলেন হুমায়ুন। এতে রাজি ছিলেন না মা।’
জাকির হোসেন আরও বলেন, ‘অপরদিকে ভাই দুলালের কাছে ৬২ হাজার টাকা পাওনা ছিলেন নুরজাহান। পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য ভাইকে প্রায়ই বলতেন তিনি। এ কারণে হুমায়ুনের মামাতো ভাই কালাম ও মামাতো বোনের জামাই সুমনও নুরজাহানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। পাশাপাশি প্রতিবেশী ইসমাইল ও আব্দুল হামিদেরও বেলালের জমির প্রতি লোভ ছিল। এজন্য হুমায়ুনকে হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করেন তারা।’
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে হুমায়ুন বলেছেন, ‘বেলালের স্ত্রীর জমি থেকে দুই শতাংশ আব্দুল হামিদকে ও বাকি আট শতাংশ ইসমাইলকে দেওয়ার মৌখিক সিদ্ধান্ত হয়। তারপর মায়ের জমি সমান পাঁচ ভাগ করে হুমায়ুন, নোমান, সুমন, কালাম ও কসাই নুর ইসলামকে দেওয়া হবে—এমন প্রতিশ্রুতিতে গত ৬ অক্টোবর বাড়ির পাশে একটি ব্রিজের ওপর বসে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেন তারা। পরে রাতে ঘরে ঢুকে বালিশ চাপা দিয়ে নুরজাহানকে হত্যা করে লাশ পাঁচ খণ্ড করে পাওনাদারদের ধানক্ষেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন তারা।’
জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘অপরাধীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে ওই নারীকে পাঁচ টুকরো করে ধানক্ষেতে ফেলে দেন। মামলার তদন্ত শেষে সাত জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ।’