X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

রহস্যময় আগুন, এস আলমের কারখানায় চিনি ছিল নাকি অন্য কিছু?

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
০৭ মার্চ ২০২৪, ২২:৫৪আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৪, ২২:৫৪

পবিত্র রমজান মাস ঘিরে বিপুল পরিমাণ চিনি আমদানি করেছিল এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। কিন্তু ‘রহস্যময় আগুনে’ পুড়ে গেছে এই চিনিকলের এক নম্বর ইউনিট। সেখানে কী পরিমাণ চিনি মজুত ছিল, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে চার দিন পার হয়ে গেছে। এখনও জ্বলছে আগুন। কবে নিভবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। এমনকি আগুন লাগার কারণও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, সেখানে কী শুধু চিনি ছিল, নাকি রাসায়নিক কিংবা অন্য কিছু। প্রশ্ন তোলার কারণও আছে।

গত ১ মার্চ বেলা ১১টার দিকে নগরীর বাকলিয়া থানা এলাকায় অবস্থিত এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন একটি হিমাগারে (কোল্ড স্টোরেজ) আগুন লাগে। আগুনে হিমাগারটি পুড়ে যায়। এ ঘটনার তিন দিন পর সোমবার (৪ মার্চ) বিকাল ৪টার দিকে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার একটি গুদামে আগুন লাগে। বৃহস্পতিবার (০৭ মার্চ) রাত ৮টা পর্যন্ত আগুন পুরোপুরি নেভেনি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। 

দুপুরে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান বললেন বাড়বে না, বিকালে বেড়েছে চিনির দাম

আগুন লাগার পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে পুড়ে যাওয়া চিনিকল দেখতে আসেন এস আলম সুপার রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আগুনে গুদামে রক্ষিত চিনির ক্ষয়ক্ষতি হলেও কারখানার কোনও ক্ষতি হয়নি। এরপরও রমজানের চাহিদা মেটানোর মতো মজুত আছে। বাজারে চিনির দাম বাড়বে না।’

তবে উল্টো চিত্র দেখা গেছে ওই দিন বিকালেই। সাইফুল আলম দাম বাড়বে না বললেও বিকাল থেকেই চট্টগ্রামের প্রধান ভোগ্যপণ্যের বাজার খাতুনগঞ্জে চিনির দাম বাড়তে থাকে। পাইকারিতে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ১০০ টাকা পর্যন্ত। এমনকি এস আলম গ্রুপের চিনির দামও বেড়েছে। গত দুদিন ধরে চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে পাঁচ-সাত টাকা বেশি দামে চিনি বিক্রি হচ্ছে। যা আগে ছিল ১৪০ টাকা কেজি।

চিনি পোড়ার তথ্যে গরমিল

পুড়ে যাওয়া গুদামে কী পরিমাণ চিনি ছিল এবং কত টাকার ক্ষয়ক্ষতি হলো সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি সাইফুল আলম। বলেছেন, আগুন নেভানোর পর জানানো হবে। তবে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা পুড়ে যাওয়া গুদামে চিনির পরিমাণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন সাংবাদিকদের।

ঘটনার দিন সন্ধ্যায় এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফয়সাল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুড়ে যাওয়া গুদামে এক লাখ মেট্রিক টনের মতো অপরিশোধিত চিনি ছিল। এর বাইরে আরও পরিশোধিত চিনি ছিল। এগুলো রমজানের জন্য ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়েছিল। এখানে পরিশোধিত হয়ে মার্কেটে যাওয়ার কথা ছিল। সব মিলিয়ে কী পরিমাণ চিনি ছিল, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। কারণ, চার লাখ মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার গুদাম এটি।’

ঘটনার পরদিন এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ কর্মকর্তা মো. হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গুদামে এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি অপরিশোধিত চিনি ছিল। যার বাজারমূল্য এক হাজার কোটি টাকার বেশি। একই স্থানে আমাদের ছয়টি চিনির গুদাম আছে। এর মধ্যে দুটিতে রিফাইন্ড করা চিনি রাখা হয়। বাকি চারটিতে অপরিশোধিত রাখা হয়। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত চিনির মজুত আছে। বাজারে দাম বাড়ার কারণ নেই।’

চার দিন পার হয়ে গেছে, এখনও জ্বলছে আগুন

তবে ২০ শতাংশ চিনি পুড়েছে এবং ৮০ শতাংশ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার বিকালে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘গুদামটিতে এক লাখ ১৬ হাজার মেট্রিক টন অপরিশোধিত চিনি ছিল বলে ধারণা করছি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ চিনি আমরা রক্ষা করতে পেরেছি।’

কীভাবে আগুন লাগলো?

প্রতিষ্ঠানের এক নম্বর ইউনিটে আগুন লেগেছে জানিয়ে এস আলম গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, ‘বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করছি আমরা। তবে বিষয়টি আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। আপাতত আর কিছু বলা যাচ্ছে না।’

তবে কীভাবে আগুন লেগেছে, কোথা থেকে সূত্রপাত, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। এমনকি চার দিন ধরে আগুন জ্বলার কারণও খুঁজে পাচ্ছেন না তারা। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেক বলেন, ‘২৫ হাজার বর্গফুটের গুদামটির উচ্চতা পাঁচ-ছয় তলা ভবনের সমপরিমাণ। এখানে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনির মজুত আছে বলে আমাদের জানান এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তারা। তবে শুধু কী চিনি ছিল নাকি অন্য কিছু, তা নিয়ে আমাদেরও সন্দেহ আছে। কেন নেভানো যাচ্ছে না, রাসায়নিক কোনও দ্রব্য ছিল কিনা; তা আগুন নেভানোর পর তদন্ত করে জানা যাবে। গুদামে যে পরিমাণ অগ্নিনিরাপত্তা (ফায়ার সেইফটি) থাকার কথা ছিল, তা ছিল না। যদি পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তা থাকতো তাহলে আগুন ছড়াতো না এবং নেভাতে এত সময় লাগতো না।’

পর পর দুটি অগ্নিকাণ্ডের পেছনে কোনও নাশকতা কিংবা ষড়যন্ত্র আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে এস আলম গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাডমিন) আকতার হাসান বলেন, ‘এতে ষড়যন্ত্র কিংবা নাশকতা আছে কিনা, তা আমি বলতে পারবো না। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পেলে জানা যাবে কীভাবে কোথা থেকে আগুন লেগেছে।’

৩টি তদন্ত কমিটি গঠন

ঘটনার দিনই আগুন লাগার কারণ জানতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেছেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে। এতে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধিরা আছেন। কমিটিকে আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।’

পাশাপাশি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ অধিদফতর। সংশ্লিষ্ট এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করার পর পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ এবং বর্ণিত ক্ষতির প্রশমন ও প্রতিরোধে করণীয় বিষয়ে সুপারিশ বা প্রস্তাবনা দেবে এই কমিটি।

এ ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুগার রিলেটেড এত বড় অগ্নিকাণ্ড বাংলাদেশে এটাই প্রথম উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘এর থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়ার আছে।’ 

আগুন কবে নিভবে তা নিশ্চিত করে জানাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস

তবে আগুন না নেভায় এখনও তদন্তকাজ শুরু করতে পারেনি তদন্ত কমিটিগুলো। আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার পর কমিটির সদস্যরা তদন্ত শুরু করবেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

দেশের বাজারে চিনি বিক্রি করে কারা?

বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক মো. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজারে চিনি বিক্রি করে পাঁচ কোম্পানি। তারা হলো- এস আলম গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, দেশবন্ধু গ্রুপ ও ইকলো। এর মধ্যে সারাদেশের চিনির বাজার এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে। কারখানায় আগুন লাগার পরদিন থেকে তাদের চিনিতে বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। প্রতি বস্তায় চিনি থাকে ৩৭ কেজি। চিনি সরবরাহ স্বভাবিক না থাকায় দাম বাড়ানো হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে পাইকারিতে এস আলমের চিনির বস্তা পাঁচ হাজার ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাকি চার কোম্পানির চিনির বস্তা চার হাজার ৯৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে দেশবন্ধু এবং ইকলোর চিনি কম বিক্রি হয়। আগে এগুলোর বস্তায় ১০০ টাকা কম ছিল। আগুন লাগার পর সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বেড়েছে বস্তায়।’ 

খাতুনগঞ্জের চিনি ব্যবসায়ী পিএন এন্টারপ্রাইজের মালিক এমদাদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এস আলমের কারখানায় আগুন লাগার পর বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। তবে আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই। পর্যাপ্ত মজুত আছে। এস আলমের চিনি সরবরাহ কম থাকলেও বাকি চার প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে।’

দাম বাড়ার কোনও কারণ দেখছে না ক্যাব

এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস চেয়ারম্যান এস এম নাজের হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগের জন্য বসে থাকে। কখন কোন অজুহাতে দাম বাড়াবে। এদেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ালে কাউকে কোনও জবাবদিহি করতে হয় না। এ কারণে এস আলম গ্রুপের চিনিকলে আগুন লাগার অজুহাতে রমজানের আগেই চিনির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ বাজারে যেসব চিনি আছে, সেগুলো আগের আমদানি। এসব চিনিতে দাম বাড়ার কোনও কারণ দেখছি না আমরা।’

/এএম/
সম্পর্কিত
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষ খবর
ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
ইউক্রেনকে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
তীব্র তাপদাহে মেয়েদের স্বস্তির সংবাদ দিলেন সালাউদ্দিন
তীব্র তাপদাহে মেয়েদের স্বস্তির সংবাদ দিলেন সালাউদ্দিন
বেসিস নির্বাচন: দেশের সফটওয়্যার খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান ইকবাল আহমেদ
বেসিস নির্বাচন: দেশের সফটওয়্যার খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান ইকবাল আহমেদ
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই