বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে হামলার অভিযোগে গত বুধবার রাতে মো. এমরান হোসেন নামের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমন্বয়ক মামলা করেছেন। মামলায় তিনি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সাবেক দুই চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ ৯৬ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করেছেন। নাম উল্লেখ করা আসামিদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মৃত তিন নেতার নাম রয়েছে। এ নিয়ে চলছে সমালোচনা।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানা সূত্রে জানা গেছে, গত বুধবার রাতে সাবেক অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামালের ছোট ভাই সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার এবং সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হাই বাবলুসহ ২৯৬ জনের বিরুদ্ধে সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলাটি করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও সমন্বয়ক এমরান।
মামলায় ২৭, ৩৩ ও ৫৫ নম্বর আসামি হিসেবে যে তিন জন আওয়ামী লীগ নেতার নাম দেওয়া হয়েছে, তারা মৃত। তারা হলেন- ২৭ নম্বর আসামি কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মো. কামাল উদ্দিন মজুমদার, ৩৩ নম্বর আসামি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক আবদুল মমিন এবং ৫৫ নম্বর আসামি উপজেলার পূর্ব জোড়কানন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ওয়াহিদুর রহমান ফরিদ। তাদের আসামি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্বজনরা। মামলার বাদী মো. এমরান হোসেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ভোলা সদর থানার শাহামাদার গ্রামের শাহাজানের ছেলে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ৪ আগস্ট আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে উপজেলার বেলতলীর মনিপুর ও চাঙ্গিনি দক্ষিণ মোড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা চালান।
তিন নেতার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কামাল উদ্দিন মজুমদার সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ারা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাওড়াতলী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। ২০২৩ সালের ১১ জুলাই মারা গেছেন। চলতি বছরের ২৪ জুন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার শিকারপুর এলাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান আবদুল মমিন। আর ওয়াহিদুর রহমান গত বছরের সেপ্টেম্বরে কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
কামাল উদ্দিন মজুমদারের প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম বলেন, ২০২৩ সালের ১১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা গেছেন। এটা গায়েবি মামলা। মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা অত্যন্ত নিন্দনীয়। প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা হলে কারও আপত্তি থাকতো না। কিন্তু এভাবে মৃত মানুষকে আসামি করলে প্রশ্ন থেকে যায়।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মমিনের ছেলে আবু সাঈদ বলেন, ‘গত ২৪ জুন ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান আমার বাবা। অথচ মামলায় তাকে ৩৩ নম্বর আসামি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ৪ আগস্ট আন্দোলনে হামলার ও ত্রাস সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে। মানে হলো বাবা কবর থেকে হামলা করেছেন। জেনে অবাক হয়েছি। এসব মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকা উচিত।’
আরেক প্রয়াত নেতা ওয়াহিদুর রহমানের বড় ছেলে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘কিডনিজনিত রোগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বাবা মারা যান। এক বছর পরের ঘটনায় বাবাকে আসামি করা হয়েছে। মৃত মানুষ কী করে হামলা করবেন, আসামি হবেন? এটি চরম অন্যায়। আমাদের হয়রানি করার জন্য এই মামলা করা হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘শুধু তিন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতাই নন, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত কয়েকজনকেও এই মামলার আসামি করা হয়েছে। এই মামলার সঠিক তদন্ত দাবি করছি।’
মামলার বাদী মো. এমরান হোসেন বলেন, ‘মামলার অভিযোগ ও অভিযুক্তদের নামে কোনও সমস্যা নেই। তবে আসামি শনাক্তে কোনও ভুল হয়েছে কিনা, সেটি আমরা দেখছি। যদি কোনও মৃত মানুষের নাম ভুলে চলে আসে, তাহলে পুলিশের তদন্তে তাকে বাদ দেওয়া হবে।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক আবু রায়হান বলেন, ‘এমরান আমাকে জিজ্ঞেস করে মামলা করতে গেছেন। তবে কাকে আসামি করবেন, এ নিয়ে কোনও যোগাযোগ বা সমন্বয় করেননি। অযথা কোনও মানুষকে হয়রানি করা অবশ্যই দুঃখজনক। মৃত মানুষকে আসামি করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা মামলাটির সঠিক তদন্ত চাই।’
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এটি এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। মামলার প্রাথমিক পদক্ষেপ। মামলাটি তদন্ত করে দেখা হবে। তদন্তেই সব বের হয়ে আসবে। এতে মৃত কোনও ব্যক্তি আসামি হলে তাদের নাম বাদ যাবে।’