ভারী বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট ও অলিগলিতে হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি জমেছে। এতে যান চলাচল ব্যাহত হয়। পানির কারণে যানবাহন আটকে থাকায় রাস্তায় যানজট সৃষ্টি হয়েছে। ভোগান্তিতে পড়েছেন পথচারী ও যাত্রীরা। এই চিত্র প্রতি বছরের। অনেকগুলো প্রকল্প নেওয়া হলেও জলাবদ্ধতা নিরসন হচ্ছে না। তবে এ দুর্ভোগ থেকে নগরবাসী মুক্তি চায়।
শনিবার বিকাল থেকে চট্টগ্রামে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। থেমে থেমে এই বৃষ্টি চলে রাতভর। রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। এতে নগরের নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। তবে নগরের বেশ কয়েকটি এলাকায় এবার জলাবদ্ধতা দেখা যায়নি। খাল ও নালা পরিষ্কার করায় এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পুরো নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে আরও এক থেকে দেড় বছর লাগবে, তখন পুরোপুরি সুফল মিলবে বলে জানিয়েছেন সিটি মেয়র।
শনিবার নগরের চকবাজারের আধুনিক চক সুপার মার্কেটের পাশের সড়কে কোমরসমান পানি জমেছে। একই অবস্থা হয়েছে চকবাজার কাঁচাবাজারে পাশের সড়কেও। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এদিন সকাল ৯টার পর থেকে তাদের এলাকায় পানি উঠতে শুরু করে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে কোমরসমান পানি জমে যায়। নগরের কাতালগঞ্জের বৌদ্ধ মন্দিরের সামনের সড়ক ও আবাসিক এলাকায়ও পানি জমে রয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে যান চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। বিকল্প সড়ক দিয়ে চলাচল করেছে গাড়ি।
এ ছাড়া নগরের কৈবল্যধামের ইস্পাহানি সি গেট এলাকায়ও হাঁটুসমান পানি জমে থাকতে দেখা যায়। জলাবদ্ধতায় এলাকাটির সড়কে গাড়ি চলাচল কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। নগরে অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা জিইসি মোড়েও হাঁটুসমান পানি জমে। পানিতে বেশ কিছু সিএনজিচালিত অটোরিকশার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। পানি মাড়িয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে পথচারীদের। নগরের মোহাম্মদপুর এলাকায়ও জলাবদ্ধতা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরের পাঠানটুলি, হালিশহর, ইপিজেড থানাধীন কিছু এলাকায় ভারী বৃষ্টিতে রবিবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি উঠেছে। যে কারণে এসব এলাকার বাসিন্দাদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে আরও এক দেড় বছর সময় লাগবে বলে মনে করছেন চসিক মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।
গত বছর ১০০ দশমিক ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে ডুবেছিল নগরের অতি গুরুত্বপূর্ণ জংশন মুরাদপুর, বহদ্দারহাটসহ বেশ কিছু এলাকা। এতে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। যার স্থায়ী ছিল বেশ কয়েক ঘণ্টা। হাঁটু থেকে কোমর সমান পানির কারণে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় বাসিন্দাদের। তবে চলতি বছরের রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৮৬ দশমিক ২ মিলিমিটার। অথচ মুরাদপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পানি জমেনি। হয়নি জলাবদ্ধতা। এটিকে ভালো চোখে দেখছেন নগরবাসী।
নগরের দীর্ঘদিনের বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চার উপদেষ্টাকে বিশেষ দায়িত্ব দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সফর করেন। চার উপদেষ্টা হলেন- পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজমও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। দায়িত্ব পেয়ে চার উপদেষ্টা চট্টগ্রাম এসে নালা, খাল পরিদর্শন করে আটটি স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে খাল-নালা সংস্কার ও মাটি অপসারণ করা হয়েছে। এর ফলে কমেছে জলাবদ্ধতা।
নগরের মুরাদপুর এলাকার বাসিন্দা মোরশেদ তালুকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে গত ১০ বছর ধরে দেখে আসছি সামান্য বৃষ্টিতেও পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় মুরাদপুর ও বহদ্দারহাটে। এবার গত দুদিনের টানা বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। খাল-নালা পরিষ্কার করায় এবার জলাবদ্ধতা হয়নি।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা কমান্ডার ইখতিয়ার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘নালার সঙ্গে খালে সংযোগ স্থাপন করেছি। যাতে পানি নেমে যেতে পারে। মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। নগরের যেসব জায়গায় সচরাচর পানি ওঠে, ওসব জায়গার খোঁজ নিয়েছি। এখন পর্যন্ত কোথাও পানি ওঠেনি। এবার আমরা পরিকল্পনা করে খাল ও নালা খনন করছি। পানিপ্রবাহের পথ পরিষ্কার থাকায় পানি জমেনি।’
চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিনটি সংস্থা। এর মধ্যে সিডিএ দুটি, সিটি করপোরেশন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একটি করে প্রকল্পের কাজ করছে। প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে পাঁচ থেকে ১১ বছর ধরে। কিন্তু এখনও কোনও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এ বছর আমরা চট্টগ্রামবাসীকে ৫০ শতাংশ জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে পারবো। শতভাগ করতে আরও এক থেকে দেড় বছর সময় লাগবে। যখন সমস্ত খাল পুরোপুরি সংস্কার করা হয়ে যাবে তখন নগরবাসী পুরোপুরি সুফল পাবে। সব সেবা প্রদানকারী সংস্থা সমন্বয় করে আমরা কাজ করছি। এ কারণে এবার শতভাগ না হলেও ৫০-৬০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়নি। আমরা কিছুটা সফল হয়েছি। যে সমন্বয় আছে সেটা ধরে রেখে কাজ করে যেতে হবে।’
চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ বিশ্বজিৎ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৮৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রামে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। গভীর নিম্নচাপ এবং মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। এটি সোমবারও অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় পাহাড় ধসের শঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে যেতে হবে।’
