চট্টগ্রামে নানা সংকটে রয়েছেন কোরবানির পশুর চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। ট্যানারির মালিকদের কাছে গত কয়েক বছরে প্রায় ২৫ কোটি টাকা পাওনা রয়েছেন তারা। বিপুল অঙ্কের টাকা আটকে থাকায় এবার চামড়া কেনা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। অনেকে অর্থের অভাবে চামড়া কেনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।
আড়তদার ও চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের প্রধান বৃহত্তম আড়ত ঢাকার সাভারের হেমায়েতপুরে বিসিক চামড়াশিল্প নগরে কোরবানির পশুর লবণ দেওয়া চামড়া বিক্রি করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা। গতবার ট্যানারির মালিকরা কিছু পাওনা পরিশোধ করলেও এখনও বাকি রয়েছে ২৫ কোটি টাকা। গত কোরবানিতে নগরে আড়তের সংখ্যা ছিল ৩৫টি। এবার পাঁচটি কমে ঠেকেছে ৩০টিতে। এ ছাড়া জেলার ১৫টি উপজেলায় রয়েছে আরও ৭০-৮০ জন আড়তদার। এর বাইরে প্রতিবার কোরবানিতে মৌসুমি আড়তদার চামড়ার ব্যবসা করেন। কিন্তু বড় অঙ্কের টাকা বকেয়া থাকায় বিপাকে পড়েছেন অনেকে।
আড়তদার ও চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার ট্যানারিতে বিক্রি করা চামড়ার টাকা না পাওয়া ও ধারাবাহিক লোকসানের বোঝা সহ্য করতে না পেরে আড়তদাররা পেশা ছাড়ছেন। এখনও ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চট্টগ্রামের আড়তদারদের প্রায় ২৫ কোটি টাকা পড়ে আছে। টাকার অভাবে অনেক ব্যবসায়ী এবার চামড়া কিনতে পারবেন না। এ কারণে কেনার চাহিদা কমে বিপুল পরিমাণ চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কা আছে।
চট্টগ্রাম চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা বলছেন, প্রতি বছর চট্টগ্রামে কোরবানিদাতা বাড়লেও কমছে আড়ত ও ট্যানারির সংখ্যা। একসময় চট্টগ্রামে ২২টির মতো ট্যানারি ছিল। পরবর্তী সময়ে একে একে ২১টি বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় রিফ লেদার নামে একটি ট্যানারি সচল আছে। এতে প্রতি বছর এক লাখ ২০ হাজার চামড়া সংগ্রহ করা হয়। বিপুল পরিমাণ চামড়া বিক্রিতে আড়তদারদের যেতে হয় সাভারের হেমায়েতপুরে বিসিক চামড়াশিল্প নগরে। কিন্তু ঢাকার ট্যানারিগুলোর মালিকরা বাকিতে চামড়া কিনে পরে অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করছেন। এতে বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাতে হয় আড়তদারদের।
নগরের চামড়া ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে চামড়া ব্যবসায়ীরা জিম্মি। সরকার চামড়ার যে দাম নির্ধারণ করে দেয়, ট্যানারির মালিকরা সে দামে কেনেন না। আবার তারা আমাদের কাছ থেকে চামড়া কিনে তার দামও পরিশোধ করেন না। বছরের পর বছর বকেয়া রেখে দিচ্ছেন। যার কারণে অনেক আড়তদার লোকসানে পড়ে তাদের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দিয়েছেন।’
চট্টগ্রাম চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। এবার লবণের দাম বস্তা প্রতি ১০০ টাকা কম আছে। গত বছর ৭৪ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছিল ৯০০ টাকায়। এবার বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। তবে বিভিন্ন এতিমখানা-মাদ্রাসায় চামড়া সংগ্রহের জন্য বিনামূল্যে লবণ বিতরণ করছে সরকার। অথচ আড়তদাররা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে ব্যবসা করছেন। তাদেরও সরকার বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করলে উপকৃত হতো সবাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েক বছর আমরা বেশি দামে চামড়া কিনে লোকসানে পড়েছি। তার ওপর ঢাকার ট্যানারিতে চামড়া দিয়ে টাকা আদায় করতে পারিনি। চট্টগ্রামে একসময় ২২টি ট্যানারি ছিল। তখন আমাদের সুদিন ছিল। এখানের ট্যানারিগুলো নগদ টাকায় চামড়া কিনে নিতো। এখন চট্টগ্রামে ট্যানারি আছে মাত্র একটি। বেশিরভাগ চামড়া ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে বিক্রি করতে হয়। ঢাকার মালিকরা বাকিতে চামড়া কিনে থাকেন। বর্তমানে ঢাকার ট্যানারিগুলোর কাছে আমাদের পাওনা রয়েছে অন্তত ২৫ কোটি টাকা।’
একসময় চট্টগ্রামে কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতিতে সদস্য সংখ্যা ছিল ১১২ জন উল্লেখ করে মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘তারা প্রত্যেকে কোরবানির পাশাপাশি সারা বছর চামড়া সংগ্রহ করতেন। বর্তমানে ৩০ জনের মতো আড়তদার চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন। লোকসানের কবলে পড়ে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে।’
চট্টগ্রাম আড়তদার সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘২০১৫ সালের পর থেকে সমস্যাটা দেখা দেয়। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এখন আমরা যারা ব্যবসা করছি, তারাও নগদ টাকায় ব্যবসা করতে পারি না। যেমন গত বছরের টাকা আমরা এখনও পাইনি। তবে ২০১৬ সাল থেকে ট্যানারিগুলো আমাদের যে বছর চামড়া নেয় সে বছর একটা অংশ দেয়। আর বড় অংশের টাকা পরের বছর কোরবানির আগে দেয়। এটা নিয়ম করে ফেলেছে। লেনদেনটা যদি নগদ করা হতো, তাহলে আমাদের অনেক সুবিধা হতো।’
সংগঠনটির সাবেক সহসভাপতি আবদুল কাদের সর্দার বলেন, ‘পুঁজি হারিয়ে দুই শতাধিক আড়তদার-ব্যবসায়ী পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকে দেউলিয়া হয়ে গেছেন। এখন যারা এই ব্যবসায় আছেন, তারা যদি পাওনা আদায় করতে না পারেন, তাহলে চট্টগ্রামে চামড়া ব্যবসা আরও খারাপ হবে।’
চট্টগ্রামে সচল আছে একটি মাত্র ট্যানারি রিফ লেদার লিমিটেড। এটির অবস্থান নগরের চান্দগাঁও থানার কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকায়। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড সেলস) মো. মুখলেছুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর এক থেকে দেড় লাখের মতো চামড়া আড়তদারদের কাছ থেকে কিনে থাকি। এবারও একই পরিমাণ চামড়া আমরা কিনবো। এজন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আলমগীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এবার কোরবানিতে জেলায় পশুর চাহিদা আছে আট লাখ ৯৬ হাজার ২৬৯টি। এর মধ্যে মজুত আছে আট লাখ ৬০ হাজার ৮৮২টি। তার মধ্যে গরুর মজুত আছে পাঁচ লাখ ৩৫ হাজার ৮১৩টি। গরুর মধ্যে তিন লাখ ৬৫ হাজার ২৯টি ষাঁড়, এক লাখ ২১ হাজার ৬৭০টি বলদ, ৪৯ হাজার ১১৪টি গাভি এবং মহিষ ৬৪ হাজার ১৬৩টি, ছাগল দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৭৪টি, ভেড়া ৫৫ হাজার ৬৯৭টি এবং অন্যান্য পশু আছে ৩৫টি।’