আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের স্মরণে কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের পাশে নির্মিত ম্যুরাল ও শহীদ মিনারের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে দুর্বৃত্তরা। বুধবার (২৫ জুন) সকাল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো ভাঙার ছবি ভাইরাল হলে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন মহলে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। তবে ঠিক কবে এগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে, তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। গত কয়েক মাস ধরে ম্যুরাল ও শহীদ মিনার ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখছেন তারা। এগুলো পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। সমালোচনার মুখে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক আমিরুল কায়ছার জানিয়েছেন, ম্যুরাল ও শহীদ মিনার পুনঃস্থাপন করা হবে।
মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজ জেলা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণাধীন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০১৪ সালে কুমিল্লা নগরের রাজগঞ্জ রাজবাড়ি কম্পাউন্ড এলাকায় এটির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠানটি লাগোয়া একটি শহীদ মিনার ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের স্মরণে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়। যেখানে ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে, সেটির পাশেই বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের পৈতৃক বাড়ি। কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন শহীদ মিনারে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ মিনারটির মধ্যখানে লাল সূর্য থাকলেও তিনটি স্তম্ভের একটিও নেই। পাশের ম্যুরালটি ভাঙা। কাচের ওপর ম্যুরালটি তৈরি করা হয়েছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুমিল্লা কালেক্টরেট স্কুল অ্যান্ড কলেজের একজন কর্মচারী জানান, কয়েক মাস ধরে এগুলো ভাঙা। ম্যুরালটি ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ভাঙা বলে মনে হচ্ছে। আর শহীদ মিনারটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে কয়েক মাস আগে। তাদের ধারণা, মাদকাসক্ত ছিন্নমূলেরা স্তম্ভগুলো ভেঙে নিয়ে গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির একজন শিক্ষক জানান, গত কয়েক মাস ধরেই প্রতিষ্ঠানে আসা-যাওয়ার সময় এমন দৃশ্য দেখছেন। তবে গত বুধবার বিকালে ম্যুরাল ও শহীদ মিনারের ভাঙা ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি ১৯৫২ সালে ভাষাশহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব করেন। রফিক তার সহযোদ্ধা আবদুস সালামকে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান এবং অন্যান্য সদস্যরাষ্ট্রের সমর্থনের আদায়ের চেষ্টা শুরু করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকো জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোতে পালিত হচ্ছে। এ গৌরবময় অবদানের জন্য ২০০২ সালে তাদের সংগঠন একুশে পদক লাভ করে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অন্যতম রূপকার বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম ২০১৩ সালের ২১ নভেম্বর কানাডার একটি হাসপাতালে মারা যান।
কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সর্বশেষ কমান্ডার শফিউল আহমেদ বলেন, ‘যারা দেশকে ভালোবাসে এবং দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তারা কখনও এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে না। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দ্রুততম সময়ের মধ্যে শহীদ মিনার এবং ম্যুরালটি আবারও পুনর্নির্মাণ করার দাবি জানাচ্ছি’
কুমিল্লার জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের ম্যুরাল এবং পাশে থাকা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলার বিষয়টি জেনেছি। তবে কখন বা কারা এগুলো ভেঙেছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এগুলো আবার পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।’