জলাবদ্ধতার কারণে বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার নিচু এলাকা কৃষকরা এক সময় আবাদ করতে পারতেন না। ফলে অনেক জমি পতিত হিসেবে পড়ে থাকতো। গত বছর থেকে এসব নিচু জমিতে ভাসমান বেডে সবজি চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বেডে বিভিন্ন প্রকার সবজির ভালো ফলন হওয়ায় লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা। জলাবদ্ধ এলাকায় সারাবছর এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যায়।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতিবৃষ্টি ও বন্যায় কখনও ডুবে না, সেচের প্রয়োজন পড়ে না, কীটনাশক দিতে হবে না, এমনকি সারেরও প্রয়োজন হবে না— এমন সবজি ক্ষেত এতদিন ছিল কৃষকদের স্বপ্নে। সেই স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত করছে কৃষি বিভাগ। দু’টি-একটি নয়, প্রায় অর্ধশতাধিক ভাসমান বেডে বিভিন্ন প্রকার সবজি আবাদ করছেন ফকিরহাটের কৃষকরা। যেসব এলাকায় প্রায় সারা বছরই জলাবদ্ধতা থাকে সেখানে কৃষি বিভাগ প্রদর্শনী মাধ্যমে কলাগাছের ভেলায় এবং কচুরিপানা দিয়ে বেড করে দিয়েছে।
ভাসমান এসব বেডে আবাদ হচ্ছে লাল শাক, ঢেঁডস, লাউসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি। এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে যথেষ্ট লাভ হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে। এছাড়া কম জমিতে বেশি ফসল আবাদ সম্ভব হচ্ছে বলে কৃষকরা জানিয়েছেন।
ফকিরহাট উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবছরই বন্যা, অতিবৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ফকিরহাট উপজেলার প্রায় ২৫ হেক্টর জলাবদ্ধ থাকে। ক্ষেত তলিয়ে ফসল নষ্ট হয়। তাই সময় মতো ফসল আবাদ করা যায় না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক কৃষকরা। তবে ভাসমান বেডে সবজি ও মশলার আবাদ করে কৃষকরা লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে।
ফকিরহাটের উত্তর পাড়া গ্রামের কৃষক গাজী রজব আলী বলেন, ভাসমান বেডে যে সবজি চাষ করা যায় আগে তাদের জানা ছিল না। ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অনুরোধে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে বেডে সবজি চাষ শুরু করেন। ফসল যা হয়েছে তা দেখে পরান জুড়িয়ে গেছে। আগামী বছর তিনি আরও বেশি বেড করে ফসল চাষ করবেন। তার ভাসমান সবজি খামার দেখে এলাকার অনেক চাষি এভাবে চাষঅবাদে আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
রজব আলী জানান, প্রথম বছর একটি ভাসমান বেডে ফসল উৎপাদন খরচ হয়েছিল ৪ হাজার টাকা। ফসল বিক্রি হয়েছে ৭ হাজার টাকা। ভাসমান বেড তৈরি করতে প্রথম বারই বেশি খরচ হয়। পরের বছর ভাসমাস বেড শুধু মেরামত করতে হয়। আর প্রতিটি বেডের মেরামত খরচ মাত্র দেড় হাজার টাকা।
কৃষক সাইফুল ইসলাম বলেন, রজব আলীর ভাসমান বেডের সবজি চাষ দেখে তিনিও একইভাবে ক্ষেত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
লখপুর গ্রামের জয়দেব মন্ডল জানান, তিনি কৃষি বিভাগের উৎসাহে ১৫ ফুট পানির ওপর ভাসমান বেড তৈরি শুরু করেন। স্থানীয়রা তাকে তাচ্ছিল্য করে অনেক কথা বলেছে। কিন্তু এখন তার ২৫টি বেডে নানা ধরনের বিষমুক্ত সবজি হচ্ছে। যা দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা প্রতিনিয়ত আসছেন। তারা এই সবজি ক্ষেত দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। আগামীতে তিনি আরও বেড তৈরি করবেন।
ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নাসরুল মিল্লাত জানান, চাষিরা কখনও ভাসমান বেডে সবজি চাষ করতেন না। এই এলাকায় নতুন এই প্রযুক্তি কৃষকদের বারবার বোঝানো হয়েছে। কিছু চাষি ভাসমান বেডে সবজি চাষ করতে রাজি হয়। এবছর তাদের এসব ভাসমান বেডে অনেক ভালো সবজি উৎপাদন হয়েছে। এতে অন্য কৃষকদের মাঝেও আগ্রহ দেখা দিয়েছে বেডে সবজি ক্ষেত তৈরি করার।
তিনি আরও বলেন, ফকিরহাটে ভাসমান বেডে সবজি উৎপদনকারী কৃষকদের মধ্যে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন তাদের ৫ হাজার, ৩ হাজার ও ২ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আফতাব উদ্দীন জানান, ভাসমান বেডে সবজি ও মশলার আবাদ সম্প্রসারণ এবং জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে কৃষি বিভাগ মাঠে কাজ করছে। এটি একটি লাভজনক পদ্ধতি।