X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

৩৮টি চেকে ৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ নাকি আরও বেশি?

তৌহিদ জামান, যশোর
২৩ নভেম্বর ২০২১, ২১:৪৯আপডেট : ২৩ নভেম্বর ২০২১, ২১:৪৯

যশোর শিক্ষা বোর্ডে একের পর এক চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটছে। এ নিয়ে চার বারে ৩৮টি চেকে প্রায় সাত কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে বোর্ডের তদন্ত কমিটি। ​অভ্যন্তরীণ ও সরকারি অডিটের দুর্বলতার সুযোগে ঘটছে এসব জালিয়াতির ঘটনা।

বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আত্মসাতকৃত টাকার পরিমাণ আরও বেশি হবে। প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা।

গত ৭ অক্টোবর যশোর শিক্ষা বোর্ডের অভ্যন্তরীণ হিসাব নিরীক্ষার সময় প্রথম জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এদিন নয়টি চেক জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় দুই কোটি টাকা আত্মসাতের তথ্য জানা যায়। দ্বিতীয় বার প্রায় ১৬ লাখ টাকা, তৃতীয় বার দুই কোটি ৪৩ লাখ টাকা ও সর্বশেষ গত রবিবার আরও এক কোটি ৮৩ লাখ টাকার জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভ্যাট ও আয়করসহ বিভিন্ন সাধারণ বিলের চেকের বিপরীতে দেওয়া কম্পিউটার প্রিন্টকৃত চেকের গ্রাহকের নাম ও টাকার অঙ্ক পরিবর্তন করে এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বোর্ডের হিসাব সহকারী আব্দুস সালাম। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন বোর্ডের নিয়মিত ঠিকাদার শরিফুল ইসলাম বাবু। শরিফুল ইসলাম বাবুর প্যাড সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংসহ পরিচিত বিভিন্ন প্রিন্টিং প্রেস ও স্টেশনারি দোকানের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে টাকা তুলেছেন। বোর্ডের অভ্যন্তরীণ ও সরকারি অডিট দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে জালিয়াতি করেছেন সালাম।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চেক জালিয়াতি কাণ্ডের হোতা আব্দুস সালামের অন্যতম সহযোগী শরিফুল ইসলাম বাবু তার ভেনাস প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের নামে আটটি চেক, তার দুলাভাইয়ের প্রতিষ্ঠান দেশ প্রিন্টার্সের নামে একটি চেক, দুলাভাইয়ের প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক কর্মচারী নূর এন্টারপ্রাইজের নামে আটটি চেক, আরেক সহযোগী আশরাফুল আলমের প্রতিষ্ঠান শাহীলাল স্টোরের নামে তিনটি চেকের মাধ্যমে টাকা তুলেছেন। এ ছাড়া শরিফুল ইসলাম বাবু যশোরের যেসব প্রতিষ্ঠানের কাজ করাতেন, সেসব প্রতিষ্ঠানের নামেও চেক জালিয়াতি করেছেন।

এর মধ্যে প্রত্যাশা প্রিন্টিংয়ের নামে পাঁচটি, খাজা প্রিন্টিংয়ের নামে দুটি, মিম প্রিন্টিং প্রেসের নামে তিনটি, অর্পানেট প্রেসের নামে দুটি, শরিফ প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি, সবুজ প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি, নিহার প্রিন্টিং প্রেসের নামে একটি, সামিয়া ইলেকট্রনিকসের নামে একটি ও বিজনেস আইটির নামে একটি চেক জালিয়াতি করেছেন।

বোর্ডের হিসাব ও নিরীক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক মো. এমদাদুল হক বলেন, অডিট শাখায় একজন অডিটর, চার জন জুনিয়র অডিটর ও একজন এলডি কাজ করেন। এই বিভাগে দীর্ঘদিন আব্দুস সালাম একা কাজ করেছেন। একজন অডিটর সাত মাস পর এসে চলে যান। ভালোভাবে কাগজপত্র চেক করে দেখেন না। কিন্তু সালাম সব কাজ করেছেন। এতগুলো পোস্টের বিপরীতে যখন একজন ছিলেন, তখন সুযোগটা নিয়েছেন। তার কাজ ছিল প্রত্যেক চেকের বিপরীতে ব্যাংক স্টেটমেন্টগুলো দেখা। এখন প্রতিবছর হাজার হাজার চেক হয়। এর মধ্যে কয়েকটি চেকে জালিয়াতি করে টাকাগুলো নিয়েছেন। পাঁচ হাজার চেক আমার পক্ষে মিলিয়ে দেখা সম্ভব না। আমার তো অনেক ফাইল ওয়ার্ক, কমিটি ওয়ার্ক করতে হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েছেন সালাম। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে দেওয়া সব চেক যাচাই করা হচ্ছে। কারণ ২০০ টাকার চেকেও জালিয়াতি করেছেন সালাম।

বোর্ডের অডিট অফিসার আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, সালাম আমাদের অন্ধকারে রেখে জালিয়াতি করেছে। তার বদলির পর বিষয়টি নজরে আসে। কিন্তু সরকারি যে অডিট হয়, সেখানেও বিষয়টি ধরা পড়েনি। তাদের নজর কীভাবে এড়িয়ে গেলো, তা বোধগম্য নয়। কারণ অডিট টিম যখন আসে তখন চাহিদাপত্র দেয়। তাদের চাহিদামতো চেকের বান্ডিল, বিভিন্ন ফাইল অনুমোদনের কাগজপত্র, ক্যাশবই, ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ সব কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়। তারা তাদের পদ্ধতিতে এসব নিরীক্ষা সম্পন্ন করেন। কোনও আপত্তি থাকলে সেটি জানান। আমরা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তার জবাব দিই। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত কোনও অডিটে চেক জালিয়াতির আপত্তি তোলা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবছরের সরকারি অডিটের আগে অভ্যন্তরীণ অডিট করতে গিয়ে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

বোর্ড সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আব্দুস সালাম হিসাব বিভাগে যোগদানের পর শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। ফলে সাত কোটি নয়, নিরপেক্ষ তদন্ত হলে টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে।

হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের বদলির পর তার স্থলাভিষিক্ত হন জুনিয়র অডিটর আব্দুর রফিক। তিনি বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব যাচাইকালে চেক জালিয়াতির বিষয়টি জানতে পারি। এরপর তা কর্তৃপক্ষকে জানাই। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর থেকে বোর্ডে কয়েকশ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। ফলে আরও জালিয়াতি হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করে বের করা দরকার। এ জন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের প্রয়োজনীয়তা আছে।

যশোর শিক্ষা বোর্ড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, শুধু ৩৮টি চেক নয়, সঠিকভাবে তদন্ত করলে আরও জালিয়াতি বেরিয়ে আসবে। দেখা যাবে সাত কোটির জায়গায় আরও বেশি অর্থ লোপাটের তথ্য মিলেছে। তার আগে এ ঘটনায় হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের পাশাপাশি অভিযুক্ত চেয়ারম্যান ড. মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব এএমএইচ আলী আর রেজাকে অপসারণ করতে হবে। তা না হলে তাদের অধীনে যত শক্তিশালী তদন্ত কমিটি হোক, তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু বলেন, যে সাত কোটি টাকা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে, তা কোন সাল থেকে কোন সাল পর্যন্ত তার সঠিক তথ্য আমরা জানতে পারছি না। যার কারণে আরও জালিয়াতি হয়েছে কিনা, অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে কিনা, তা গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের প্রয়োজন। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন জরুরি। একইসঙ্গে বোর্ডকে দুর্নীতিমুক্ত করতে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

এদিকে, চেক জালিয়াতি করে সাত কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। ১৪ নভেম্বর বিকালে তদন্ত কমিটির প্রধান কলেজ পরিদর্শক কে এম রব্বানি বোর্ড সচিবের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন।

এ ঘটনায় মামলা করেছে দুদক। দুদকের করা মামলার পাঁচ আসামির মধ্যে বোর্ড চেয়ারম্যান ড. মোল্লা আমীর হোসেনের নাম থাকলেও তিনি দাবি করেছেন, তার তৎপরতায় জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

তিনি বলেন, ধাপে ধাপে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। আমার ধারণা, জালিয়াতির আরও তথ্য মিলতে পারে। ফলে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে।

শিক্ষা বোর্ডের তথ্যমতে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে কম্পিউটার প্রিন্ট চেক পদ্ধতি চালু করা হয়। ওই অর্থবছর থেকে চলতি অর্থবছর পর্যন্ত চেকের মাধ্যমে ২৯১ কোটি নয় লাখ ৫০ হাজার ৭১২ টাকার লেনদেন করা হয়।

/এএম/
সম্পর্কিত
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
দাফনের ১৫ দিন পর তোলা হলো ব্যাংক কর্মকর্তার মরদেহ
হাসপাতালের ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
সর্বশেষ খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের