‘গত তিন বছর ধরে মা আমাকে দেখতে আসেন না। তার বয়সও হয়েছে অনেক। বৃদ্ধ বাবা আছেন। কিন্তু তিনি ২০০৯ সালের পর আর দেখতে আসেননি। মা থাকেন এক ভাইয়ের সংসারে, বাবা থাকেন আরেক ভাইয়ের সংসারে। করোনাকালের আগে ২০১৯ সালে ঈদের সময় সর্বশেষ মায়ের সঙ্গে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাৎ হয়েছিল। এরপর আর দেখা করতে আসেননি কেউ। তাদের জন্য মন কাঁদে।’
এভাবেই কথাগুলো বলেছেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সুমন আকন। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছেন তিনি। এই কারাগারে ঈদের দিন কাটবে তার।
সুমন আকন বলেন, ‘২১ বছরের বেশি ধরে কারাবাস করছি। যশোরের আগে অন্যান্য কারাগারে ছিলাম। এই কারাগারে প্রচুর জায়গা, পানির কোনও সমস্যা নেই। গাছপালাও রয়েছে বেশ। এককথায় পরিবেশটা সুন্দর।’
তিনি জানিয়েছেন, ঈদের দিনটা কারাবন্দিদের জন্য অন্যরকম একটা দিন। এদিন সকালে কয়েদি-হাজতি সবাই গোসল সেরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিংবা যাদের নতুন জামা-কাপড় থাকে, তারা সেগুলো পরেন। কারা কর্তৃপক্ষ সকালে অন্যদিনের তুলনায় ভিন্ন ও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেন। কারা অভ্যন্তরে ঈদের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে নানা রঙের বেলুন ও রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। বাইরের থেকে একজন ইমাম আসেন। তার ইমামতিতে নামাজ আদায় করেন সবাই। কিন্তু স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে না পারায় মন কাঁদে সবার।
গত চার বছর ধরে সাজা খাটছেন মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন অনেক খারাপ লাগে। গত চারটা বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছি। স্বজনদের জন্য মন কাঁদে এদিন। আবার যাদের সঙ্গে থাকি, তাদের সঙ্গে চেষ্টা করি আনন্দ ভাগাভাগি করার। একটা ভালো ব্যাপার আছে, এখানে ঈদের দিন সবাই আমরা একসঙ্গে খাবার খাই, গল্প করে সময় কাটাই।’
কয়েদি আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদের আগেরদিন থেকে সবাই প্রস্তুতি নিই। কারাগারের মাঠ বেলুন, রঙিন কাগজ দিয়ে গেট সাজানো হয়। নামাজ আদায়ের মাঠে কম্বল বিছানো হয়। ঈদের আয়োজন অনেক সুন্দর হয়। কিন্তু পরিবারের মতো আনন্দ কারও মনে থাকে না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিত্তবান অনেক বন্দির পরিবার ঈদের আগে দেখা করতে এসে নতুন জামা-কাপড় দিয়ে যান। তারা ঈদের দিন সেগুলো পরেন। তবে অনেক বন্দি রয়েছেন, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন পরিবারের কেউ দেখা করতে আসেন না। তারা নতুন পোশাক পান না। অন্যদের নতুন পোশাক পরতে দেখলে মন খারাপ হয় তাদের।
কারা সূত্র জানায়, করোনাকালে বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেননি অনেকের স্বজন। তবে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে এক সপ্তাহ পর পর মোবাইলে কথা বলার সুযোগ দিয়েছেন কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান।
কয়েদিরা জানান, জেলার মানবিক মানুষ। তিনি বন্দিদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন। ঈদের দিন খাবারের জন্য বিশেষ আয়োজন থাকে। জেলার নিজ উদ্যোগে কয়েকজনের পোশাকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ঈদের আগে বিত্তবানদের কেউ যদি অসহায় বন্দিদের পোশাকের ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে ঈদের আনন্দ সবাই একসঙ্গে উপভোগ করতে পারতেন।
যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, ‘যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক হাজার ১২৯ জন বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে কয়েদি ৫৭৪ ও হাজতি ৫৫৫। তাদের মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৮২ ও নারী ৪৭ জন।’
তিনি বলেন, ‘ঈদের দিন সকালে পায়েস ও মুড়ি দেওয়া হয়। কখনও কখনও পায়েসের স্থলে সেমাই খেতে চান বন্দিরা। ঈদের তিন দিন আগে প্রতিটি ওয়ার্ড থেকে বন্দিদের প্রতিনিধিদের নিয়ে আমরা একটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছি। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের খাবার দেওয়া হবে ঈদের দিন। তবে বেশিরভাগই ঈদের দিন দুপুরে আমরা পোলাও, খাসি-গরুর মাংসের আয়োজন করি। ক্ষেত্র বিশেষে মুরগির রোস্ট, শুকনো মিষ্টি ও পান-সুপারি থাকে। রাতে সাদা ভাত, রুই মাছ, সবজি অথবা ডাল দেওয়া হয়।’
বরাদ্দ বাড়লে খাবারের আয়োজন আরও ভালো করা যেতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত বরাদ্দ জনপ্রতি ৯৭ টাকা এবং বিশেষ দিনে ১৫০ টাকা। এই টাকায় আসলে খুব বেশি ভালো মানের খাবার সরবরাহ করা যায় না। তবু আমরা চেষ্টা করেছি, ঈদের দিনে ভালো খাবার দেওয়ার।’