X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সুন্দরবনে থামছে না বিষ দিয়ে মাছ শিকার 

আবুল হাসান, মোংলা 
২১ মার্চ ২০২৩, ১৪:৫৭আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ১৫:১৮

বিশ্বখ্যাত ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের নদী ও খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার চলছেই। এতে বনের মৎস্য সম্পদ ও জলজসহ বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু বনরক্ষীদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছেন।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটারের বেশি, যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। এই জলভাগে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে ১৩টি বড় নদ-নদীসহ ৪৫০টির মতো খাল। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হওয়া এই বনের নদ-নদী ও খালে ভেটকি, রুপচাঁদা, দাঁতিনা, চিত্রা, পাঙাশ, লইট্যা, ছুরি, মেদ, পাইস্যা, পোয়া, তপসে, লাক্ষা, কই, মাগুর, কাইন, ইলিশসহ ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ হয়ে থাকে। এ ছাড়া রয়েছে গলদা, বাগদা, চাকা, চালী, চামীসহ ২৪ প্রজাতির চিংড়ি। 

উপকূলীয় এলাকা ও বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্বৃত্তরা পাস পারমিট নিয়ে বনে প্রবেশের সময় নৌকায় বিষাক্ত কীটনাশক নিয়ে যায়। পরে জোয়ারের আগে কীটনাশক চিড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে মিশিয়ে নদী ও খালের পানির মধ্যে ছিটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ কীটনাশকের তীব্রতায় নিস্তেজ হয়ে পানিতে ভেসে ওঠে। তারা ওই মাছ উঠিয়ে প্রথমে স্থানীয় আড়তে নিয়ে যায়। কোনও কোনও জেলে আবার বন বিভাগের পাস ছাড়াই বনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এ প্রক্রিয়ায় মাছ শিকার করেন। এসব মিশমিশ্রিত মাছ পরে সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন হাটবাজারে। 

স্থানীয়রা জানান, সুন্দরবনের অভ্যন্তরে ঢাংমারী, মরাপশুর, জোংড়া, ঝাপসি, ভদ্রা, নীল কমল, হরিণটানা, কোকিলমুনী, হারবাড়িয়াসহ শরণখোলা, সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জের আশপাশ এলাকায় স্থানীয় অসাধু কিছু জেলে নামধারী মৎস্য দস্যু বিষ দিয়ে মাছ ধরছে। বেশি মুনাফার আশায় সুন্দরবনের বিভিন্ন নিষিদ্ধ খালেও বিষ দিয়ে মাছ শিকার করা হয়। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলে নামধারী মৎস্য দুর্বৃত্তরা স্থানীয় কিছু মৎস্য আড়তদার, দাদনদাতা ও স্থানীয় কিছু নেতার লোকজন। তারা জেলেদের মোটা অংকের টাকা দিয়ে এ কাজ করতে বলেন। তাদের সঙ্গে আছে এক শ্রেণির অসাধু কীটনাশক বিক্রেতা। চক্রের লোকজন ওই বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবাধে কীটনাশক সংগ্রহ করে তা মাছ ধরার কাজে অপব্যবহার করছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বনবিভাগের কিছু অসাধু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা উৎকোচের বিনিময়ে এসব জেলেকে বনে মাছ ধরার অনুমতি দেন।

সংগৃহীত ছবি

মোংলা বাজার মৎস্য সমিতির সভাপতি আফজাল ফরাজি বলেন, স্থানীয় কিছু আড়তদার এ চক্রকে নিয়মিত মোটা অংকের টাকা দাদন দিয়ে সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরতে পাঠান। এদের কারণে এখন বাজারে সুন্দরবনের মাছ তেমন একটা পাওয়া যায় না। তবে তিনি এ চক্রের কোনও সদস্যের নাম বলতে রাজি হননি।

বন বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, বিষ দিয়ে মাছ ধরায় জেলেদের অনেককে একাধিকবার গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই কাজে জড়িয়ে পড়েন তারা। 

কৃষিকাজে পোকা দমনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক দিয়ে এসব মাছ শিকার করা হয়। এর মধ্যে ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড এবং পেসিকল নামক কীটনাশকই বেশি ব্যবহার করেন জেলেরা। জেলেদের দাবি, এই বিষ বাজারের যে কোনও কীটনাশক দোকান থেকে সংগ্রহ করা যায়। 

মোংলা শহরের ১ নম্বর লেবার জেটি এলাকার তাহের এন্টারপ্রাইজ নামে সার ও কীটনাশক দোকানের মালিক আবু তাহের জানান, এসব কীটনাশক কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য চাষিরা কেনেন। এগুলো দিয়ে সুন্দরবনের খালে মাছ মারা হয় কিনা তা তার জানা নেই। কৃষি বিভাগ অনুমোদন দেওয়ার পরই এই কীটনাশক বিক্রি করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষ দিলে মাছের সঙ্গে সব প্রজাতির জলজ প্রাণীই মারা যায়। এটা জীববৈচিত্র্যের জন্য খুবই মারাত্মক। পরিবেশের ওপর যেমন বিরূপ প্রভাব পড়ে অন্যদিকে বিষে মরা ওই মাছ খেয়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী। 

তারা বলছেন, সুন্দরবনের জলজ পাখির প্রধান খাবার নদী ও খালের ছোট মাছ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সুন্দরবনের নদী-খাল থেকে মাছ শিকার করতে ব্যবহার করা হচ্ছে কীটনাশক ও বিষ। এই বিষে মাছের পাশাপাশি খালের পানিতে থাকা বিভিন্ন পোকা-মাকড়ও বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। বিষাক্ত এসব প্রাণী খাবার হিসেবে গ্রহণ করে পাখি। ফলে বিষক্রিয়ায় অনেক প্রজাতির পাখিও মারা যাচ্ছে।

সংগৃহীত ছবি

মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান চিকিৎসক শাহিন জানান, বিষাক্ত পানির মাছ খেলে মানুষের পেটের পীড়াসহ কিডনি ও লিভারে জটিলতা দেখা দেয়। 

মোংলা উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানান, সুন্দরবনের ভেতরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি এর ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। 

মোংলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘মাছ ধরতে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তা ধানসহ বিভিন্ন শাকসবজির খেতের ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ মারার কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি খুবই বিষাক্ত। মোংলার কীটনাশক বিক্রেতা ও ডিলারদের নির্দেশনা দেওয়া আছে যেন তারা তালিকাভুক্ত চাষি ছাড়া অন্য কারও কাছে এসব বিক্রি না করেন।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, ‘কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয় সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। ফলে ওই এলাকার খাদ্যচক্রে প্রভাব পড়ে। আবার এই কীটনাশকমিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেসব খালে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়, তার বিষক্রিয়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় চার মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত থাকে।’

বেসরকারি সংস্থা ‘সেভ দ্য সুন্দরবন’র চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরায় শুধু সুন্দরবনের মৎস্যসম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এই বিষাক্ত পানি পান করে অন্য বন্যপ্রাণীরাও মারাত্মক হুমকির মধ্যে রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলো বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। সরকারের এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবনে অসাধু মাছ ব্যবসায়ী ও জেলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রায় সময়েই অভিযান চালিয়ে এদের গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তারা দ্রুত আদালত থেকে জামিনে এসে আবার একই কাজ করেন। 

গ্রেফতারের পর কেন দ্রুত জামিনের বেরিয়ে আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষ দিয়ে শিকার করা মাছ শনাক্ত করার মেশিন আমাদের কাছে নেই। তাই এ বিষয়ে প্রমাণ আদালতে উপস্থান করা যায় না।’

/আরআর/
সম্পর্কিত
তীব্র গরমেও শীতল করমজল!
সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করা ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঘ, নিয়ে গেলো গহীন বনে
মৎস্যঘের থেকে স্যাটেলাইট ট্রান্সমিটার বসানো কুমির উদ্ধার
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা