শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে পদত্যাগের মিছিল। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্যসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদত্যাগ করেছেন। যাদের নিয়োগ হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন আওয়ামী পরিবারের হলেও তার পদত্যাগ চাননি শিক্ষার্থীরা। এরপরও মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) সকালে তিনি পদত্যাগ করেছেন। তবে তার পদত্যাগের পর চলছে জল্পনা-কল্পনা। শিক্ষার্থীরা তাকে উপাচার্য হিসেবে চাইলেও তার পদত্যাগের নেপথ্য হিসেবে কয়েকটি কারণ উঠে এসেছে।
উপাচার্য পদত্যাগ পত্রে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ উল্লেখ করেন। কিন্তু পদত্যাগের আগে শিক্ষার্থীদের কাছে ‘অসম্মানজনক পরিস্থিতি এড়াতে’ পদত্যাগ করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, তিনি তার টিম নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তার টিমের পদত্যাগ চেয়েছিলেন। তাতে উপাচার্যেরও আপত্তি ছিল। এ কারণে তার মতবাদকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি আন্দোলনকারীদের পূর্ণ সহায়তা দিয়েছেন। পুলিশকে ক্যাম্পাসে প্রবেশের অনুমতি না দিয়ে আন্দোলনকারীদের আস্থার পাত্র হয়ে ওঠেন। এসব কারণে আওয়ামী পরিবারের সদস্য হাওয়ার পরও আন্দোলনরতরা তার পদত্যাগ চাননি। কিন্তু তার সহকর্মীদের পদত্যাগ চাইছিলেন। কিন্তু উপাচার্য তার টিম নিয়ে থাকতে চাইলে তার টিমের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির নানা অভিযোগ ওঠে। উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়ে তিনি দলীয় লোকজন নিয়োগ দেওয়া, উন্নয়নমূলক কাজে দলীয় লোকজনকে প্রধান্য দেওয়া, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেও কোনও পদক্ষেপ না নেওয়াসহ নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব বিষয় আলোচনায় আসায় তিনি এটিকে অসম্মানজনক মনে করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্টি ডিসিপ্লিনের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী একরামুল হক বলেন, ‘আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ চাননি। কিন্তু উপ-উপাচার্যসহ অন্য সবার পদত্যাগ চেয়েছেন। ফলে ওই অবস্থায় তিনি দায়িত্ব পালন করা ঝুঁকির ও অসম্মানজনক হতে পারে বলে মনে করেছেন। এ কারণে সবার সঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করেছেন। তিনি চেয়েছেন সম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে দায়িত্বশীলতা।’
ইংরেজি ডিসিপ্লিন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জিহাদ হাসান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, উপাচার্য নিজ পদে থাকবেন। কিন্তু উপ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ট্রেজারার, হল প্রোভোস্টদের পদত্যাগ করতে হবে। এরপর উপাচার্য দাবি করেন, টিম ছাড়া তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এরপর শিক্ষার্থীরা নীরব হয়ে যান। কিন্তু এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনিয়ম নিয়ে পোস্ট হয়। যা নিয়ে ক্যাম্পাসেও গুঞ্জন ওঠে। ভিসি অনিয়ম না করলেও টিমের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগে তিনি অসম্মানজনক মনে করেছেন। তাই টিমের সঙ্গে তিনিও পদত্যাগ করেছেন। তিনি অসম্মানজনকভাবে পদে থাকতে চাননি।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি ও খুবির পরিসংখ্যান ডিসিপ্লিনের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জহুরুল তানভির খুবি উপাচার্যের পদত্যাগের পর বিকাল ৩টার দিকে ফেসবুকে তার টাইমলাইনে এক পোস্টে লেখেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম শুধু ভিসি স্যার থাকুক এবং দুর্নীতিবাজ, বিতর্কিত শিক্ষকদের পদত্যাগ! কিন্তু ভিসি স্যার চেয়েছেন টিম নিয়ে থাকবে! মনমতো টিম নিয়ে থাকা আরেকটি স্বৈরাচারী মতবাদের প্রকাশ! অবশেষে পদত্যাগ!’
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৫ মে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির ১২তম উপাচার্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭২ সালের ২২ আগস্ট বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার মধ্য কচুবুনিয়া গ্রামে জন্ম মাহমুদ হোসেনের। তিনি বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হোসেনের ছেলে। ১৯৯৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স থেকে বনবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার পুত্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানগ্রোভ ইকোলজির ওপর স্নাতকোত্তর এবং ২০০৪ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি পান। অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন ১৯৯৯ সালে শিক্ষক হিসেবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ২০০১ সালে তিনি সহকারী অধ্যাপক, ২০০৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০০৯ সাল থেকে ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনে অদ্যাবধি অধ্যাপক পদে দায়িত্বরত আছেন। তিনি মালয়েশিয়ার পুত্রা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানগ্রোভ ইকোলজি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার ১০৫টি গবেষণা নিবন্ধ আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। এখন পর্যন্ত তার প্রকাশিত পুস্তকের সংখ্যা ৩টি, অনুবাদ ২টি। দেশি ও বিদেশি সংস্থার অর্থায়নে ২৬টি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন তিনি।
তার উদ্যোগ ও নেতৃত্বে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের মধ্যে প্রথম সয়েল আর্কাইভ স্থাপন হয়েছে। প্রফেসর ড. মাহমুদ হোসেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য, ফরেস্ট্রি এন্ড উড ডিসিপ্লিনের বিভাগীয় প্রধান, বোর্ড অব অ্যাডভান্স স্ট্যাডিজের সদস্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক উপদেষ্টা।