X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পাঁচ বছরের প্রকল্প: ৪ বছরে অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ, ব্যয় ৪৫০ কোটি টাকা

আতাউর রহমান জুয়েল, ময়মনসিংহ
০১ জুলাই ২০২৩, ০৮:০১আপডেট : ০১ জুলাই ২০২৩, ০৮:০১

ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ মুখথুবড়ে পড়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের চার বছরে অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ। এ সময়ে খননকাজে ব্যয় হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। ধীরগতিতে খননকাজের ৪৬ শতাংশ অগ্রগতির পরও ব্রহ্মপুত্র নদে প্রত্যাশিত পানির প্রবাহ ফিরে আসেনি। উল্টো খননকাজের অনেক এলাকায় নতুন করে ছোট-বড় চর জেগে উঠেছে। নদের অনেক জায়গায় হাঁটুসমান পানি। হেঁটে নদ পার হচ্ছেন অনেকে। খনন কোনও কাজে আসেনি দাবি করে এ নিয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ জেলা নাগরিক আন্দোলনের নেতাসহ সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদে ইতোমধ্যে নানা শ্রেণিপেশার মানুষ আন্দোলনে নেমেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ খননের কাজ করছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর ব্রহ্মপুত্র নদ খনন এলাকার রক্ষণাবেক্ষণের কাজও করবে বিআইডব্লিউটিএ। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং এই প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হওয়ার কথা। চার বছরের মাথায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। করোনা পরিস্থিতি, প্রকল্পের অর্থ ছাড়ে ধীরগতি, ব্রহ্মপুত্র খনন, খননের বালু রাখা নিয়ে স্থানীয়ভাবে বাধা সৃষ্টি এবং সমন্বয়হীনতা প্রকল্পের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে বলে দাবি বিআইডব্লিউটিএর।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার টোক থেকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের যমুনার উৎস মুখ পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। দুই হাজার ৭৬৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের ৩০ জুন শেষ হওয়ার কথা। পাকুন্দিয়া, গফরগাঁও, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ সদর, মুক্তাগাছা, জামালপুর, শেরপুর ও গাইবান্ধা পর্যন্ত নদ খননের কাজ করার কথা। চুক্তিবদ্ধ ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নদের ২২৭ কিলোমিটারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ে পাকুন্দিয়া উপজেলার টোক থেকে ময়মনসিংহ ও জামালপুর পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার এলাকা খনন শুরু করে। এর মধ্যে টোক থেকে ময়মনসিংহ সীমানার ১১০ কিলোমিটার ও জামালপুরের ৫০ কিলোমিটারে খনন চলছে। এজন্য জামালপুর ও ময়মনসিংহে আলাদা ড্রেজার বেইজড তৈরি করা হয়েছে। খননকাজে ৩৫টি ড্রেজার যোগ দেয়। শুরুতে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার টোক পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার পর্যন্ত নদে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে সারা বছর নৌ-চলাচলের উপযোগী করা হবে।

ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ চলছে ধীরগতিতে

প্রকল্পের কাজের অগ্রগতির কথা জানিয়ে বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও ব্রহ্মপুত্র খননকাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মহসিন মিয়া বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় ১০০ মিটার (৩০০ ফুট) প্রশস্ত ও তিন মিটার (প্রায় ১০ ফুট) গভীর খননের মাধ্যমে নৌপথটি ক্লাস-২ নেভিগেশনাল রুটে উন্নীত করা হবে। এতে পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদে সারা বছর নৌযান চলতে সক্ষম হবে। প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ১৬০ কিলোমিটারসহ জামালপুর পর্যন্ত ১৯০ কিলোমিটার খনন করা হবে। পরবর্তীতে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে গাইবান্ধার এলেন্দাবাড়ি ইউনিয়নের সন্ন্যাসীর চর পর্যন্ত আরও ৩৭ কিলোমিটার খনন করা হবে। প্রকল্পের মেয়াদে ধাপে ধাপে ব্রহ্মপুত্র নদের তিনটি লেয়ার খনন করা হবে। প্রথম ধাপে ব্রহ্মপুত্র নদের একটি লেয়ার খননের কাজ চলছে।’

বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে একনেক সভায় ব্রহ্মপুত্র নদ খনন প্রকল্প পাস হওয়ার পর খননকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের শুরুতে। এ সময় করোনা পরিস্থিতির কারণে খননকাজ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রকল্পের অর্থ ছাড় নিয়ে সংকট খননকাজ বাধাগ্রস্ত করেছে। ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের ভাটি থেকে উজানের দিকে খনন চলে ধীরগতিতে। টোক থেকে শুরু হওয়া খননকাজ চলে মুক্তাগাছা উপজেলা অভিমুখে। টোক, গফরগাঁও, ত্রিশাল, ঈশ্বরগঞ্জ, গৌরীপুর, ময়মনসিংহ সদরের জয়নুল আবেদিন পার্ক, পুলিশ লাইনস, জেলখানা ঘাট ও মুক্তাগাছা পর্যন্ত প্রথম লেয়ারের খননকাজ করা হয়। এভাবেই পার হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদের চার বছর। কাজ হয়েছে ৪৬ শতাংশ। এজন্য খরচ হয়েছে ৪৫০ কোটি টাকা। প্রথম লেয়ার খননের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ব্রহ্মপুত্র নদ তিন মিটার গভীর ও ১০০ মিটার প্রশস্ত করার কাজও দৃশ্যমান নয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় লেয়ার খনন শুরুই হয়নি। তবে খনন এলাকার মধ্যে বেশ কিছু পয়েন্টে তিনবার বালু কাটা হয়েছে। খনন চললেও ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ে গড়ে উঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নেই কোনও উদ্যোগ। এ অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। প্রকল্পের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়তে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। সেইসঙ্গে বাড়তে পারে প্রকল্পের ব্যয়ও।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদের বিরাট অংশজুড়ে জেগে উঠেছে অনেকগুলো চর। এসচ চরের কোথাও হাঁটুপানি। হেঁটে পার হচ্ছেন অনেকে। অনেক জায়গায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানির প্রবাহ নালার মতো। ময়মনসিংহ নগরীর খাগডহর, জেলখানার ঘাট, পুলিশ লাইনস, শিল্পাচার্য জয়নুল উদ্যান, কাচারিঘাট, জুবলি ঘাট, থানার ঘাট কালিবাড়িসহ বেশ কিছু এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের এমন দশা।

ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ চলছে ধীরগতিতে

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার চলতি মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ব্রহ্মপুত্র নদ খননের প্রকল্প হাতে নিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়। বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদে শুষ্ক মৌসুমে ১০ ফুট পানির প্রবাহ থাকবে। প্রশস্ত হবে ৩০০ ফুট। এমনটি হলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হবে। বদলে যাবে ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পাড়ের মানুষের জীবনধারা।

নৌপরিবহন ব্যবস্থা চালু হলে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে। উন্নয়ন ঘটবে মৎস্যসম্পদের। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া কমে আসবে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ চার বছর শেষ হওয়ার পর এখনও কোনও কিছু দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন স্থানীয়রা।

এমন পরিস্থিতিতে ‘জনউদ্যোগ’ নামে একটি সংগঠন খাগডহর ও কাচারিঘাট এলাকায় ক্যাম্পেইন করেছে। এর আগে খননের নামে ব্রহ্মপুত্র নদকে মেরে ফেলা হচ্ছে এমন অভিযোগ এনে কাচারিঘাট এলাকায় হাঁটুসমান পানিতে নেমে ‘মৃতের চিৎকার’ ব্যানারে মানববন্ধন করেছে ময়মনসিংহ শহর ও কয়েকটি উপজেলা থেকে আসা তরুণ-তরুণীরা। এ সময় তারা বিষাদের গান গেয়ে প্রতিবাদ জানান।

সর্বশেষ গত ৭ মে ময়মনসিংহ নগরীর শহীদ ফিরোজ জাহাঙ্গীর চত্বরে নাগরিক আন্দোলন মানববন্ধন ও সমাবেশ করে পরিকল্পিতভাবে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের দাবি জানান। গত ১৪ মে নাগরিক আন্দোলন তাদের প্রতি সমর্থন আদায়ে পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে। এরপর গত ২১ মে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে নাগরিক আন্দোলন।

ব্রহ্মপুত্র নদের খননকাজ চলছে ধীরগতিতে

ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট এএইচএম খালেকুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার উৎসমুখ খনন না করা পর্যন্ত এর সুফল মিলবে না।’

তিনি বলেন, ‘চার বছরে খননকাজের অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ। এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ নিয়ে সাধারণ মানুষসহ নাগরিক নেতৃবৃন্দের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। খননকাজ দ্রুত করার উদ্যোগ নিতে হবে।’

খননকাজের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী মহসিন মিয়া বলেন, ‘যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের সংযোগস্থল খননের বিষয়টি আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে। প্রথমে এই সংযোগস্থল খনন করা হলে পানির তোড়ে পুরো খননকাজ বাধাগ্রস্ত হবে। তাই খনন শুরু হয়েছে ভাটি থেকে উজানের দিকে। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ব্রহ্মপুত্র নদে পানি প্রবাহ দৃশ্যমান হবে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
‘সরকার রাস্তার জমি উদ্ধার করতে পারে, নদী কেন পারে না?’
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
সর্বশেষ খবর
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস খাদে পড়ে নিহত ৫
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাস খাদে পড়ে নিহত ৫
উত্তর আমেরিকা চবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটির অভিষেক
উত্তর আমেরিকা চবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটির অভিষেক
লোপেজের জোড়ায় লিগে রানার্সআপ হওয়ার পথে বার্সা
লোপেজের জোড়ায় লিগে রানার্সআপ হওয়ার পথে বার্সা
বাজারে অপরিপক্ব লিচু, খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
বাজারে অপরিপক্ব লিচু, খেলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিফুল দিয়ে বরণ, রিট দিয়ে শুরু কোন্দল!
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা