আজ (৩১ জুলাই) ছিটমহল বিনিময় ও তা বাংলাদেশ এবং ভারতে একীভূত হওয়ার প্রথম বর্ষপূতি। বাংলাদেশের ভেতরে সবচেয়ে বেশি ছিটমহল ছিল লালমনিরহাট জেলায়। এগুলো বিলুপ্ত হয়ে এখন মূল ভূখণ্ডে যুক্ত। এ জেলার ৫৯টি বিলুপ্ত ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিরা গত এক বছরে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে দৃশ্যমান অনেক সুবিধাই পেয়েছে। তবে এখনও চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা, স্কুল-কলেজ, স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক হয়নি। নতুন নাগরিকত্ব পাওয়া বাংলাদেশিদের এ নিয়ে রয়ে গেছে ক্ষোভ ও হতাশা।
বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো ঘুরে দেখা যায়, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য লালমনিরহাট পাটগ্রাম উপজেলার ভেতরে বিলুপ্ত ১৬ নম্বর ভোটবাড়ী ছিটমহলে একটি পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জনবল নিয়োগ ও জায়গা নির্ধারণ করা হলেও এখন পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করা হয়নি। ফলে পুলিশ সদস্যরা পার্শ্ববর্তী বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে কাজ করছেন বলে জানান পাটগ্রাম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) অবনী শংকর কর।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, আপাতত পুলিশ সদস্যরা পাশের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে রয়েছে। তবে শিগগিরই ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হবে।
কুলাঘাটের বিলুপ্ত ভিতরকুটি ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি হারুন-উর রশীদ বলেন, ‘অনেকেই দীর্ঘ ৬৮ বছরের যাযাবর জীবন কাটিয়েছে। কেউ স্বাধীনতা দেখার আগেই মারা গেছেন। আজ যারা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ তাদের জন্যই বিলুপ্ত ছিটমহলে পর্যাপ্ত সংখ্যক স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া মা-বোনদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনেরও দাবি জানাচ্ছি। আমাদের কেউ নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই আমাদের একমাত্র ভরসার জায়গা। আমরা তাঁর কাছে এসব দাবির বাস্তবায়ন চাই।’
লালমনিরহাট জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু আশরাফ নূর জানান, সরকারিভাবে কোনও বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয়ভাবে কয়েকটি বিলুপ্ত ছিটমহলে নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এগুলোতে এখনও পাঠদানের অনুমতি মেলেনি বলে তিনি জানান।
লালমনিরহাট জেলা সিভিল সার্জন ডা. এএফএম আহসান হাবিব বাবু জানান, সাড়ে ছয় হাজার অধিবাসীর স্বাস্থ্যসেবার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণের নিয়ম রয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে পাটগ্রাম উপজেলার জোংড়া ইউনিয়নের বিলুপ্ত ১১২ নম্বর ছিটমহলে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছি। সরকারি নির্দেশনা পাওয়া গেলে আরও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হবে।
লালমনিরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নবেজ উদ্দিন সরকার জানান, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধাসহ লালমনিরহাটের বিলুপ্ত ছিটমহলে চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই এসব স্কুল চালু করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
লালমনিরহাট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী বাদশা মিয়া বলেন, সদর উপজেলা, হাতীবান্ধা ও পাটগ্রাম উপজেলার ভেতরে বিলুপ্ত ৫৯টি ছিটমহলের মধ্যে জনবসতিপূর্ণ ৪০টিতে ১৮৮টি আধাপাকা পায়খানা ও ৯০টি টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। একটি পায়খানা বসাতে ১১ হাজার ও একটি টিউবওয়ে বসাতে ১৬ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে বলে তিনি জানান।
লালমনিরহাট জেলা পরিষদ প্রশাসক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান বলেন, ‘আমার আত্মার সঙ্গে মিশে গেছে নতুন বাংলাদেশিরা। ফলে আমি সেখানে যতবার গিয়েছি ততোবারই উন্নয়ন ভাবনা বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোয় পায়খানা ও টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ শেষ হওয়ার পথে রয়েছে। পাটগ্রামের বিলুপ্ত ১৬ নম্বর ভোটবাড়ী ছিটমহলে পুলিশের একটি তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জোংড়া ইউনিয়নের বিলুপ্ত ১২ নম্বর বাঁশকাটায় একটি তথ্যসেবা কেন্দ্র ও একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। ভূমি মালিকানার জন্য মাঠ জরিপের মাধ্যমে পর্চা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলার ভিতরকুটিতে একটি শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন, মৎস্য, প্রাণি সম্পদ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পাকা রাস্তা নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বর্ষার পরেই তা বাস্তবায়ন সম্পন্ন হবে। এছাড়া চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম চলছে। উচ্চ বিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির স্থাপনের কাজ চলছে।
সাবেক ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলা ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল ইসলাম জানান, এখনও রাস্তা নির্মাণ করা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ কেউই পায়নি। বিদ্যালয় স্থাপন কাজ শুরু হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বিলুপ্ত ছিটবাসীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য আরও কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে। সরকারি চাকরিতে বিলুপ্ত ছিটমহলের ছেলে-মেয়েদের জন্য বিশেষ কোটা দাবি করেন তিনি।
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোতাহার হোসেন এমপি বলেন, ‘৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আদলেই ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। সেই চুক্তি মোতাবেক নতুন বাংলাদেশিদের উন্নয়নে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ, জাতীয় পরিচয়পত্র, স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলছে। তথ্যসেবা কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জমির মাঠ পর্চাও হাতে দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রীরামপুর ইউনিয়নে বিলুপ্ত ১৬ নম্বর ভোটবাড়ী ছিটমহলে পুলিশের একটি তদন্ত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বর্ষার পরেই পাকা রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হবে। বিলুপ্ত ছিটমহলের নতুন বাংলাদেশিদের প্রত্যাশানুযায়ী সব দাবি পূরণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বদ্ধ পরিকর। সামনে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের মধ্যদিয়ে ভোটাধিকারও নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ ৬৮ বছরের যাযাবর জীবনের দিন বদলে যুব উন্নয়ন, মৎস্য, প্রাণি সম্পদ, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে নারী-পুরুষদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজও এগিয়ে চলছে।
/এফএস/টিএন/আপ-এমপি/