X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

কুড়িগ্রামে সচ্ছলদের হাতে কার্ড, হতদরিদ্ররা বঞ্চিত

আরিফুল ইসলাম
১৩ অক্টোবর ২০১৬, ০৭:৪১আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:২৮

কুড়িগ্রাম হতদরিদ্রদের জন্য চালু হওয়া ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’  ১০ টাকা কেজি মূল্যের চালের কার্ড বিতরণ নিয়ে চরম অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে।
অভিযোগ উঠেছে— স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মাধ্যমে স্বচ্ছল পরিবারের মধ্যেই অধিকাংশ চালের কার্ড বিতরণ হওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন প্রকৃত হতদরিদ্ররা। এমনকি উপজেলার দু‘টি আবাসন প্রকল্পে আশ্রয় নেওয়া ভূমিহীন হতদরিদ্ররা এই কর্মসূচির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন।
চাল বিতরণে অনিয়মের কথা স্বীকার করেছেন খোদ উপজেলা চেয়ারম্যান মো. নজির হোসেন এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরাও।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফুলবাড়ীর বালাহাট বাজারের ছাদ পেটানো ভবনের (মার্কেট) মালিক নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের পূর্বফুলমতি গ্রামের হায়দার আলী, গজেরকুটি গ্রামের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু তালেব, পূর্বফুলমতি গ্রামের জয়নাল, পশ্চিম ফুলমতি গ্রামের হেলাল; এরা সকলেই অবস্থাসম্পন্ন সচ্ছল পরিবারের সদস্য হলেও সকলে রেশন কার্ড নিয়ে  ১০ টাকা কেজি দরের চাল উত্তোলন করেছেন।
এছাড়াও অনেক স্বচ্ছল পরিবার ১০টাকা কেজি মূল্যের চালের কার্ড পেয়েছে বলে জানান নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রেজাউল ইসলাম বন্ধন। তিনি বলেন, অনেক হতদরিদ্র মানুষ কার্ড পাননি, অথচ যারা উপার্জনক্ষম এবং এই সুবিধা পাওয়ার যোগ্য নন তারা কার্ড পেয়েছেন। স্বচ্ছল ও অবস্থা সম্পন্ন পরিবারের কার্ড বাতিল করে সেগুলো হতদরিদ্র গরীবদের মাঝে বিতরণ করার দাবি জানান তিনি।

এদিকে, উপজেলার ভড়ভিটা ইউনিয়নের বড়লই মৌজার ডিলার ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে কার্ডধারীদের কাছ থেকে চালের বস্তার মূল্য বাবদ ১০ টাকা করে আদায় এবং হতদরিদ্রদের এসব চাল বাজারে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চাল গ্রহণকারী জানান, ‘বাবা, হামরা গরিব মানুষ, কিছু বুজবার পাই না। যেমন করি কইছে তেমন করি টাকা দিছি।’

তবে ডিলার আব্দুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা।  

ডিলারের বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা স্বীকার করে ভড়ভিটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান খয়বর আলী মিয়া জানান, আমিও তার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ পেয়েছি। এরপর তাকে  বারণ করায় আর এমনটা করেনি।

ভড়ভিটা ইউনিয়নে অনেক হতদরিদ্র মানুষ  ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ কার্ড পায়নি, এমন অভিযোগ সত্য উল্লেখ করে এই ইউনিয়ন চেয়ারম্যান বলেন, ‘কিছুটা অনিয়ম তো হয়েছে। চাল বিতরণ কর্মসূচির জন্য যে তালিকা করা হয়েছে তা প্রায় ৫/৭ বছর আগের। আমি আগে থেকে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কাছে তালিকা চেয়েও পাইনি। চাল বিতরণের মাত্র তিন দিন আগে আমার কাছে তালিকা পাঠানো হয়েছে। ফলে তালিকা সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। এর ফলে অনেক হতদরিদ্র মানুষ কার্ড পায়নি।’

জানা যায়, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল ৯ টায় দিকে উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে ১২ জন ডিলারের মাধ্যমে প্রথম পর্যায়ে ৯২৯৮ জন কার্ডধারীর মধ্যে নির্ধারিত কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে ৩০ কেজি করে চাল বিতরণ কর্মসূচির উদ্বোধন করা হয়। উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের দুইটি ও ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নে একটি সরকারিভাবে গড়ে ওঠা আবাসন প্রকল্পের (গুচ্ছ গ্রামের) প্রায় ২৩৩ ভূমিহীন পরিবার ১০ টাকা কেজি দরে চালের কার্ড পায়নি এবং সেই সঙ্গে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে আরও অনেক হতদরিদ্র পরিবার বাদ পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নাওডাঙ্গা ইউনিয়নে গোরকমণ্ডল বস্তিতে বসবাস করে ৯০ পরিবারে প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। সেখানে চাল পেয়েছে মাত্র তিনটি পরিবার। চর গোরকমণ্ডল গুচ্ছ গ্রামে বসবাস করে ৩৫ পরিবার । সেখানে পেয়েছে ২৬ পরিবার। ফুলবাড়ী সদর ইউনিয়নের ফুলসাগর গুচ্ছ গ্রামে বসবাসরত ১১৮ পরিবারের কেউই রেশন কার্ড পাননি। আবাসনের বাসিন্দাদের প্রশ্ন, ‘হামার চেয়ে গরিব কাই? হামরায় যদি চাউল না পাই তাইলে পাইবে কাই?’

নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের বস্তি গোরকমণ্ডল আবাসনের বাসিন্দা বিধবা সবিজন (৬০) জানান, কখনও কাজ করে আবার কখনও ভিক্ষা করে তার দিন চলে। কিন্তু সরকারের ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ কার্ড তিনি পাননি। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছেন কিন্তু কোনও প্রতিকার পাননি তিনি। একই আবাসনের সত্তর বছর বয়স্ক বাসিন্দা লতিফ মিয়ার জীবন চলে অন্যের ক্ষেতে কাজ করে। তিনিও পাননি রেশন কার্ড। লতিফ মিয়া বলেন, ‘মাইনষের বাড়িত কামলা দিয়া খাই। কাম থাকলে খাই, না থাকলে ঘরের পাঁচ জনক নিয়া উপাস থাকা নাগে। চাউলের কার্ডটা পাইলে খুব উপকার হয়। হামাক কার্ড না দিয়া যামার ভাল চলে তামাক (যারা বড়লোক তাদের দেওয়া হয়েছে) দিছে।’ একই অভিযোগ করেন আবাসনের অন্যান্য হতদরিদ্র বাসিন্দারা। তাদের প্রশ্ন, ‘হামার চাউল গেল কই?’

নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের বস্তি গোরকমণ্ডল আবাসনের সভাপতি মোন্নাফ হোসেন জানান, ‘আমি নিজেই আবাসনের ৯০ টি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে মেম্বার এবং পরে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে চালের কার্ডের কথা জানালে তিনি জানান,আপনাদের কার্ড নেই যাদের কার্ড আছে তারাই শুধু এ চাল পাবে। পরে কোন উপায় না পেয়ে ফেরত আসি। তিনি আরও জানান, আমাদের তো জায়গা জমি নেই জন্য সরকার থাকার ব্যবস্থা করে দিছে। এখন প্রধানমন্ত্রী আমাদের খাবার ব্যবস্থা করে দিলেও আমাদের সেই খাবার লুট হইতেছে। আপনারা এটা প্রধানমন্ত্রীকে জানান।’

এ ব্যাপারে নাওডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান মুসাব্বের আলী মুসা জানান, ১০ টাকা কেজি চালের কার্ড ৭-৮ বছর আগে করা। তৎকালীন চেয়ারম্যান এবং আওয়ামীগের নেতারা কার্ডধারীদের তালিকা করেছে। এখানে আমার কিছুই করার নেই। তবে বেশির ভাগ স্বচ্ছল পরিবার এ কার্ড পেয়েছে। এ তালিকা আমার আমলে হয়নি। আমরা শুধু কার্ডগুলো নাম অনুযায়ী তাদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়েছি। একই ব্যক্তির নামে দুই থেকে তিনটি কার্ডে থাকায় আমি এই ডাবল কার্ড সংশোধন করে শুধু দুই জন ব্যক্তিকে বণ্টন করে দিয়েছি। তাছাড়া আমার করার কিছুই নেই।

আবাসনের হতদরিদ্ররা চালের কার্ড পায়নি স্বীকার করে ইউপি চেয়ারম্যান মুসাব্বের আলী মুসা বলেন, আগামীতে যাতে প্রকৃত হতদরিদ্ররা চাল পায় সে ব্যবস্থা করা হবে।

এ ব্যাপারে ফুলবাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান মো. নজির হোসেন জানান,‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির চাল বিতরণে কিছুটা অনিয়ম হচ্ছে। উপজেলার অনেক হতদরিদ্র ব্যক্তি কার্ড পায়নি। আমি কয়েকবার উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার কাছে তালিকা চেয়েও পাইনি। আমার ধারণা ডিলারদের সঙ্গে উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তার যোগসাজসে এমন অনিয়ম হচ্ছে।’

অনিয়মের সমাধান কি জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান মো. নজির হোসেন জানান, অনেকের নাম আছে কিন্তু তারা চাল পায় না। আমি অতি শীঘ্রই নামের তালিকা সংগ্রহ করে সংশোধন করে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করবো যাতে করে তালিকার সকলে চাল পায় ।

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন এর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ‘আমি একটা প্রোগ্রামে আছি, এখন এ ব্যাপারে কথা বলতে পারবো না।’

উল্লেখ্য, ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ’ শ্লোগানকে সামনে রেখে চলতি বছরের ৭ সেপ্টেম্বর চিলমারী উপজেলার থানাহাট এ ইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ইউনিয়ন পর্যায়ে হতদরিদ্র পরিবারের মাঝে নির্ধারিত কার্ডের মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরনের ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এ কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবার ১০ টাকা কেজিতে প্রতিমাসে ৩০ কেজি করে চাউল পাবে। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর, আক্টোবর, নভেম্বর এবং মার্চ ও এপ্রিল এই পাঁচ মাস কর্মসূচির আওয়তায় চাল পাবে হতদরিদ্র পরিবার গুলো। বছরের এই মাসগুলোতে শ্রমজীবী মানুষগুলোর কাজের অভাব থাকে। ফলে এই পাঁচ মাস তাদের ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’-র মাধ্যমে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে।

কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এর কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ২৫ হাজার ২শ’ ৭৯ টি পরিবার এ কর্মসূচির আওতায় চাল পাবে। কিন্তু শুরুতেই নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনায় এই কর্মসূচি কতটা ফলপ্রসু হবে তা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।

/এইচকে/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ততৃীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১৫৮৮ জন
ততৃীয় ধাপে উপজেলা নির্বাচন: মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ১৫৮৮ জন
মুঠোফোন কানে, ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
মুঠোফোন কানে, ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু
পড়ার টেবিল দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৮
শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজপড়ার টেবিল দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৮
পেঁয়াজ নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জানালেন কৃষিমন্ত্রী
পেঁয়াজ নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা জানালেন কৃষিমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে
সজলের মুগ্ধতা অপির চোখে, জন্মদিনে