X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইলে সবই হাতছাড়া খান পরিবারের

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৮আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:১২

অভিযুক্ত এমপি রানা ও তার তিন ভাই

প্রভাবশালী খান পরিবারের মসনদ টলে গেছে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে। মুক্তিযোদ্ধাকে খুনের অভিযোগের পর গ্রেফতার হয়েছেন চার খানের মধ্যে বড় ভাই ঘাটাইল আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা। সেখান থেকেই এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ।  এ অপকর্মে জড়িত অভিযোগে তার অপর তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধেও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে দল। বর্তমানে এ বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলাসহ আরও একাধিক মামলায় গ্রেফতার এড়াতে এমপি রানার বাকি তিন ভাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এছাড়াও চাঁদাবাজি, নির্যাতন, দলের অন্য নেতাদের ভয় ভীতি দেখিয়ে পদ দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। রাজনীতিবিদদের ধারণা, এ ঘটনায় শেষ হয়ে গেল টাঙ্গাইলে খান পরিবারের টানা ৭ বছরের একচ্ছত্র আধিপত্য।   

টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে বরাবরই প্রভাব ছিল আলোচিত খান পরিবারের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বছর খানেকের মধ্যে জেলার রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু আমানুর রহমান খান রানা এমপি ও তার ভাইদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অভিযোগ রয়েছে, তারা কৌশলে ও প্রতিপক্ষকে ভয় ভীতি দেখিয়ে একের পর এক দখল করে নেন জেলার বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক সংগঠনের শীর্ষ পদ।

টাঙ্গাইলের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক নেতা অভিযোগ করেছেন, আমানুর রহমান খান রানা সংসদ সদস্য হওয়ার পর তার তিন ভাই হুট করে জেলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক শীর্ষ পদগুলোতে আসতে থাকেন। এসব পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা কেউ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথে যাননি। বিভিন্নভাবে ভয় ভীতি দেখিয়ে ও কৌশলমূলক সমঝোতার আশ্রয় নিয়ে তারা পদগুলোতে আসীন হন। ফলে সবাই নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।

তবে টাঙ্গাইল পৌরসভার মেয়র পদে অবশ্য নির্বাচন করেই জয়লাভ করেন এমপি আমানুর রহমান রানার ভাই সহিদুর রহমান খান মুক্তি। সেসময় প্রভাবের পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও ছিল তার। তবে ভাই রানা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনিও সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও সহিদুর টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগ এবং টাঙ্গাইল জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এসময় তার বিরুদ্ধেও প্রভাব বিস্তার, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে। তবে এমপি রানার অফিসে মুক্তিযোদ্ধা ফারুককে হত্যার ঘটনার পর তারা ভীষণ চাপে পড়ে যান। হত্যা মামলায় রানাসহ তার অপর তিন ভাইয়ের নাম ওঠায় তারাও আত্মগোপনে চলে যান।

সহিদুর রহমান খান গত ২০ নভেম্বর পৌর পরিষদের কাছে তিন মাসের একটি ছুটির আবেদন দিয়ে আত্মগোপন করেন। ছুটির মেয়াদ শেষে না ফিরে দ্বিতীয় দফায় ছুটির মেয়াদ আবারও বাড়িয়েও আর ফেরেননি।

আত্মগোপনে থাকায় সহিদুর টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক পদ হারান এবং ২০১৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। সেই নির্বাচনে বিএনপি মনোনিত প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জামিলুর রহমান মিরন। সম্মেলনের মাধ্যমে টাঙ্গাইল শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম এ রৌফ এবং টাঙ্গাইল জেলা শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হন জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভির হাসান ছোট মনি।    

জানা গেছে, এমপি রানার বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে মোট ৪৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে সাক্ষী না থাকা, প্রভাব খাটানোসহ বিভিন্নভাবে ৪৪টি মামলা খারিজ হয়ে যায়। তবে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা ও ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টার মামলাটি এখনও রয়েছে রানার বিরুদ্ধে। ফারুক হত্যা মামলায় গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে তিনি। অন্যদিকে, তার ভাই সাবেক পৌর মেয়র মুক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে ৩৬টি মামলা। অপর দুই ভাই কাকন ও সানিয়োতের বিরুদ্ধেও রয়েছে হত্যাসহ বেশ কটি মামলা। এসব মামলায় ২০১৪ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে এমপি আমানুর রহমান খান রানার তিন ভাই আত্মগোপনে চলে যান।  ফলে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না তাদের। এ কারণে  আস্তে আস্তে বিভিন্ন সংগঠন থেকে গুরুত্বপূর্ণ পদ তাদের হাতছাড়াও হতে থাকে। শহরেও কমতে থাকে তাদের প্রভাব।

এমপি রানার অপর ভাই জাহিদুর রহমান খান কাকন ছিলেন টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি, ভিক্টোরিয়া রোড ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, জেলা ব্যবসায়ী ঐক্যজোটের সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিব।

আত্মগোপনে যাওয়ার পর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাশেম। ভিক্টোরিয়া রোড ব্যবসায়ী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তালেবুর রহমান। আর জেলা ব্যবসায়ী ঐক্যজোটের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। এছাড়া জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির মহাসচিব হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন জার্মান আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গোলাম কিবরিয়া বড় মনি।

রানার ছোট ভাই কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানিয়াত খান ছিলেন টাঙ্গাইল রাইফেলস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। তিনি আত্মগোপনে যাওয়ার পর এই পদে নির্বাচিত হন সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাইদুর রহমান। সানিয়াত জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সম্পাদক হিসেবে জেলা ক্রিকেট উপপরিষদের সাধারণ সম্পাদক। ক্রীড়া সংস্থার কমিটির মেয়াদ এমাসেই শেষ হচ্ছে।

এ ছাড়া তিনি সরকারি সা’দত কলেজ ছাত্র সংসদের এবং টাঙ্গাইল কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের কমিটির মেয়াদ শেষে সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন মির্জাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ ওয়াহিদ ইকবাল। কলেজ ছাত্র সংসদের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

গত ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে জেলা কমিটি বিলুপ্ত হলে আমানুরের ধর্মবিষয়ক সম্পাদকের পদটি চলে যায়। নতুন করে গঠিত এ কমিটিতে আমানুর বা তার কোনও ভাইকে কোনও পদে রাখা হয়নি। এমনকি তার নির্বাচনি এলাকা ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগেও স্থান হয়নি আমানুরের।

সর্বশেষ গত সোমবার আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিন ভাইকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ। সভার কার্যবিবরণী অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

এমনকি মাটিকাটা শ্রমিক ইউনিয়ন, গরু ও ঘোড়ার গাড়ি শ্রমিক ইউনিয়নসহ নাম সর্বস্ব বিভিন্ন সংগঠনের উপদেষ্টাসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের নাম ছিল। এখন কোথাও তাদের আর কোনও নাম নেই।

টাঙ্গাইল জেলা গ্রিল প্রস্তুতকারী শ্রমিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ মো. খোরশেদ আলম (খসরু) জানান, সহিদুর রহমান খান মুক্তি যখন মেয়র ছিলেন তখন তাকে ওই সংগঠনের উপদেষ্টা বানানো হয়। তারপর তিনি আত্মগোপনে গেলে উপদেষ্টা পদে আর তাকে রাখা হয়নি।

টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলাম বলেন, সীমা লংঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। তারা (আমানুর ও তার ভাইরা) অন্যায় করতে করতে এত বেশি অন্যায় করেছে যে একেবারে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মূল সংগঠন থেকে তারা বিচ্যুত হয়ে গেছে। এখনও দুই একটা সংগঠনে তাদের নাম রয়ে গেছে। সে সব সংগঠনেও অতি দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই তাদের স্থলাভিষিক্ত হবে।

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি টাঙ্গাইল শহরের কলেজপাড়া এলাকায় নিজ বাসার সামনে থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ফারুক আহমেদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ২১ জানুয়ারী নিহত ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদী হয়ে টাঙ্গাইল সদর থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করেন। টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ ফারুক হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাংসদ আমানুরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আনিসুল ইসলাম রাজাকে ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট ও মোহাম্মদ আলীকে ২৪ আগস্ট গ্রেফতার করে। ২৭ আগস্ট আনিসুল ইসলাম ও ৫ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ আলী টাঙ্গাইলের বিচারিক হাকিম আদালতে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বের হয়ে আসে, এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে এমপি আমানুর এবং তার তিন ভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা জড়িত। এর পরপরই কাকন ও বাপ্পা আত্মগোপনে চলে যান। আর একই বছরের নভেম্বরে আত্মগোপন করেন সাংসদ আমানুর ও সহিদুর।

গতবছর ৩ ফেব্রুয়ারি আমানুর এবং তার তিন ভাইসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর আমানুর রহমান খান রানা গত ১৮ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইলের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।

/টিএন/

আরও পড়ুন: ‘রিকশা থামিয়ে জাপানি নাগরিককে গুলি করে জঙ্গি মাসুদ রানা’

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ