X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়র মিরু ও তার দুই ভাইয়ের যত অপকীর্তি

আমিনুল ইসলাম খান রানা, সিরাজগঞ্জ
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৭:৫২আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৮:০৫

শাহজাদপুর পৌরসভার মেয়র হালিমুল হক মিরু

সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল হত্যায় অভিযুক্ত শাহজাদপুর পৌরসভার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মেয়র হালিমুল হক মিরু আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পর তার ও তার পরিবারের নানা অপকীর্তির কথা এখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে। তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করলেও কোথায় কোন অঞ্চলে যুদ্ধ করেছেন তা কেউ জানে না। মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, পাবনা শহরে থাকলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তাকে কেউ চিনতো না। স্বাধীনতার পর সবাই তাকে চিনতে শুরু করে জাসদ গণবাহিনীর লোক হিসেবে। আর সুবিধাবাদী এই নেতা নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে তার অবস্থান পোক্ত করেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে এর আগেও বহিষ্কারও করা হয়েছিল তাকে। তবে সেসব ঘটনা সামাল দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি তৃণমূল থেকে মনোনয়ন না পেলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করে মেয়র পদের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। আর নির্বাচিত হন এলাকায় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে ভোটারদের ভয় ভীতি দেখিয়ে।

এলাকাবাসী জানান, মিরু হলেন শাহজাদপুরের চরাঞ্চল নলুয়া এলাকার বাসিন্দা। কিন্তু তার বেড়ে ওঠা পাবনায়। শিক্ষাজীবনও শুরু হয় সেখানে। পরে শাহজাদপুর কলেজে পড়তে আসেন তিনি। নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয়দানকারী মিরু কোথাও কোনও যুদ্ধ করেননি বলে দাবি শাহজাদপুরের মুক্তিযোদ্ধা আজাদ শাহনেওয়াজ ভূঁইয়ার। তার ভাষ্য, ‘মিরু কোথায় যুদ্ধ করেছেন তা কেউ জানে না। তাকে শাহজাদপুরের মানুষ এক-আধটু চিনেছেই জাসদের রাজনীতিতে আসার পর।’

সাংবাদিক শিমুল হত্যায় যুক্ত থাকার কারণে এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে মিরুকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। আর এ ঘটনার পর গত শুক্রবার দুপুর থেকেই তিনি এলাকা ছাড়া। এমনকি তার মোবাইল ফোনও বন্ধ।

তবে গ্রেফতার করা হয়েছে মেয়র মিরুর দুই ভাই হাবিবুল হক পিন্টু ও হাসিবুল হক মিন্টুকে। মিরুর কুকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তার এই দুই ভাই। বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) শিমুল হত্যার প্রেক্ষাপটও তৈরি হয়েছে তাদের হাতে।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার শাহজাদপুর সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি বিজয় মাহমুদকে ধরে নিয়ে মারধর করেন পিন্টু ও মিন্টু। ওইদিন সকালে বিজয় যাচ্ছিলেন মেয়রের বাড়ির পাশ দিয়ে। তাকে দেখামাত্র ধরে নিয়ে যান পিন্টু, তারপর মারধর করেন।

বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে, পিন্টু ও বিজয়ের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত হয় পৌর নির্বাচনের সময় থেকে। ওই নির্বাচনে বিজয়ের দুলাভাই আবদুর রহিম মেয়র মিরুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন। এই বিরোধ তুঙ্গে ওঠে বিজয়দের বাড়ির সামনের রাস্তা মেরামত ও সংস্কার কাজ অসমাপ্ত রাখা নিয়ে। ওই রাস্তার কাজটি পান পিন্টু ও মিন্টুর অনুগত ঠিকাদাররা। অভিযোগ রয়েছে, ইচ্ছে করেই বিজয়দের বাড়ির সামনের রাস্তাটির সংস্কার কাজ অসমাপ্ত রাখা হয় পিন্টু-মিন্টুর ইন্ধনে।

অবশ্য নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হলেও শুরুতে দলের তৃণমূল থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন আবদুর রহিম। এবিষয়ে সিরাজগঞ্জ-৬ (শাহজাদপুর-এনায়েতপুর) আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে আবদুর রহিমকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, কেন্দ্রে গিয়ে সব উল্টে যায়। কেন্দ্র থেকে মনোনয়ন পান মেয়র মিরু। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে আমরা নির্বাচন করি মিরুর পক্ষে। রহিমকে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে তাকে বহিষ্কার করি।’

পৌর নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম। তার দাবি, ওটা ছিল শাহজাদপুরের ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস নির্বাচন। নির্বাচনের আগে থেকে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে মিরু ও তার সমর্থকেরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরুর পরিবারের সদস্যরা অনেকেই এখনও জাসদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তার দুই ভাইয়ের মধ্যে হাবিবুল হক মিন্টু পাবনা জেলা জাসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন। মেয়র মিরুর দুই ভাইয়ের নামেই পাবনার একটি থানায় মাদক মামলা রয়েছে। আর মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহচর মো. নিস্তার হোসেনের নামে আছে হত্যাসহ ১৪টি মামলা। জানা গেছে, শাহজাদপুরে আধিপত্য বিস্তারে এই নিস্তারকে ডেকে আনা হয়। পৌর নির্বাচনের সময় তারই বাহিনী তাণ্ডব চালিয়েছিল।

এদিকে শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) সকালেও নিজের বাসায় ছিলেন মেয়র। ছিল কড়া পুলিশি প্রহরা। সকালে বাসায় বসে ইলেকট্রনিক চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেয়র দাবি করেন, তিনি আত্মরক্ষার্থে একটি মাত্র গুলি করেছিলেন।

কিন্তু, তার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে পুলিশ। ঘটনার বিভিন্ন ফুটেজেও দেখা যাচ্ছে, টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন সাংবাদিক শিমুল। তবু পুলিশি পাহারা এড়িয়ে মেয়র মিরু পালালেন কেমন করে, এই প্রশ্ন এখন শাহজাদপুরের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয়।

এ প্রসঙ্গে শাহজাদপুর সার্কেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসানাত শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকালে শাহজাদপুর পাইলট হাইস্কুল মাঠে শিমুলের জানাজাপূর্ব আলোচনা সভায় দাবি করেন, ‘বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে মেয়রের বাড়ির সামনে পাহারায় ছিল পুলিশ। এদিন দুপুরে তার বাড়ির সামনে বিক্ষুব্ধরা মিছিল নিয়ে এলে পুলিশের উপস্থিতিতে এবং পুলিশকে ডিঙিয়ে তিনি নিজের শটগান দিয়ে বেশ ক’রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এরই একটি লেগে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক শিমুল।’

পরে দুপুর ১টার দিকে মেয়র মিরুকে গ্রেফতার করা হলো না কেন, মোবাইল ফোনে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন— ‘এতোবড় একজন লোক! যার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই, তাকে হঠাৎ ধরবো কি করে?’

বিষয়টি জানার পর পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘শাহজাদপুর সার্কেল অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল হাসনাত কেন এ ধরনের বক্তব্য দিলেন, তা আমার জানা নেই। আগে বিষয়টি জানতে হবে। তবে, শিমুল নিহত হওয়ার ঘটনায় আসামিদের ধরতে পুলিশের আন্তরিকতার কোনও অভাব নেই। যারা পলাতক আছেন তারাও গ্রেফতার হবেন।’

আপাতত গ্রেফতার এড়িয়ে গেলেও মেয়র মিরুকে শাহজাদপুর আওয়ামী লীগের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন রবিবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আবার বললেন, ‘উপজেলা আওয়ামী লীগ থেকে মেয়রকে বহিষ্কারের জন্য আজ দুপুরে সুপারিশ করা হয়েছে। শিমুলের মতো একজন সাংবাদিক যে কিনা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে খুন হলেন, তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।’

এর আগে ১৯৯৬ সালে দলীয় প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়ায় এবং ২০০৪ সালে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন হালিমুল হক মিরু। বর্তমানে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তবে এই পদ থেকে বহিষ্কারের জন্য এখনও কোনও প্রস্তাব ওঠেনি তার বিরুদ্ধে।

/জেএইচ/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজায়ন ও জলাধার রক্ষার বিকল্প নেই’
‘জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবুজায়ন ও জলাধার রক্ষার বিকল্প নেই’
চামড়া খাতে ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা প্রস্তাব
চামড়া খাতে ন্যূনতম মজুরি ২২ হাজার ৭৭৬ টাকা প্রস্তাব
রবিবার থেকে ‍দুটি বেঞ্চে চলবে আপিল বিভাগের বিচারকাজ
রবিবার থেকে ‍দুটি বেঞ্চে চলবে আপিল বিভাগের বিচারকাজ
‘বাংলাদেশ দলে থেকে উন্নতি হয়েছে’
‘বাংলাদেশ দলে থেকে উন্নতি হয়েছে’
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ সাত দফা দাবি সরকারি কর্মচারীদের
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
গাজীপুরে ট্রেন দুর্ঘটনা: স্টেশন মাস্টারসহ ৩ জন বরখাস্ত
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে