দিনাজপুর দরবার শরীফে নিহত কথিত পীর ফরহাদ হোসেন চৌধুরী এক সময় বিএনপির সক্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। কিন্তু দলের কিছু নেতার অসহযোগিতা ও কূটকৌশলের কারণে তিনি পৌর নির্বাচনে হেরে যান। পরে পৌর বিএনপির কমিটি থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়। এরপরই তিনি রাজনীতি থেকে সরে আধ্যাত্মিক লাইনে চলে যান বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা জানান, সারাজীবন দলের জন্য অনেক কিছু করেছেন ফরহাদ হাসান চৌধুরী। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি পৌরসভা নির্বাচনে প্রার্থী হন। ওই সময় দিনাজপুর থেকে বিজয়ী হওয়া খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশিদ জাহান হক ছিলেন মন্ত্রী। বেশ কয়েকবার ফরহাদ হাসানকে জেতানোর জন্য মন্ত্রী নিজে বৈঠক করেছেন। কিন্তু বিএনপির কিছু নেতার অসহযোগিতা ও কূটকৌশলের কারণে পৌর নির্বাচনে হেরে যান ফরহাদ হাসান। পরে পৌর বিএনপির কমিটি থেকেও তাকে বাদ দেওয়া হয়। এই ক্ষোভে রাজনীতি ছেড়ে দেন তিনি। পরে অনেক যোগাযোগ করেও তাকে দলে আর ফেরানো যায়নি।
তিনি বলেন, ‘যে দরবার শরীফ ফরহাদ হাসান গড়ে তুলেছিলেন সেখানে নামাজ বিদ্বেষী কথাবার্তা হতো। জিকিরে হিন্দু-মুসলিম একত্রে ধ্যানে মগ্ন থাকতো। এ কারণে অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ ছেড়ে দেন।’
দিনাজপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান বাবু জানান, বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীলে ফরহাদ হাসান ছিলেন পৌর বিএনপির সভাপতি। ওই সময়ে তিনি দিনাজপুর পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু নির্বাচনে তিনি হেরে যান। এরপরই তিনি রাজনীতি ছেড়ে দেন। এরপর এক সময় নিজের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ির পার্শ্বে গড়ে তোলেন কাদেরিয়া দরবার শরীফ। সেখানেই তিনি বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন।
তিনি জানান, কিছুদিন আগে তার সঙ্গে ফরহাদ হাসানের দেখা হয়েছিল। কথাবার্তায় তেমন কোনও পরিবর্তন ছিল না। আগের মতোই হাসিখুশি আর অমায়িক ব্যবহার ছিল তার।
এলাকাবাসী বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছে, ফরহাদ হোসেন দীর্ঘদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি দিনাজপুর সদরে ব্যবসাও করতেন। কিন্তু, হঠাৎ করে ২০০৭-০৮ সাল থেকে তিনি রাজনীতি ও ব্যবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন। ২০১০ সালে বোচাগঞ্জে কাদরিয়া মোহাম্মদিয়া দরবার শরীফ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। এরপর থেকে দরবার শরীফেই বেশি সময় কাটাতেন। এক সময় তিনি নিজেকে ‘পীর’ বলে দাবি করতে শুরু করেন। সেখানে দরবার শরীফে অসংখ্য মুরিদ ও ভক্ত নিয়মিত মাহফিল ও ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা করতেন। এদের সবাই ফরহাদ হোসেন চৌধুরীকে ‘বাবা’ বলে ডাকতেন।
ঘটনার তিনদিন আগে তার পালিত মেয়ে রূপালী বেগমের বিয়ে দেন সিরাজগঞ্জ থেকে আগত সিরাজুল ইসলাম নামে তার কথিত মুরিদের সঙ্গে। কিন্তু, পীর ও তার মেয়ে নিহত হওয়ার ঘটনার পর থেকে সিরাজুল নিখোঁজ রয়েছে।
ভক্ত ও অনুসারীরা জানান, কাদরিয়া মোহাম্মদিয়া দরবার শরীফে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়কে একইসঙ্গে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হতো। হিন্দু কিংবা মুসলিম এখানে কোনও ভেদাভেদ নেই। সবাই পীরের ভক্ত। সবাইকেই তিনি ‘ধর্মজ্ঞান’ দিতেন।
ভক্ত লিপি সরকার জানান, ‘বাবা (ফরহাদ হোসেন) বৃহস্পতি ও সোমবার এখানে জিকির করতেন। ঈশ্বরের আরাধনায় সারারাত কাটিয়ে দিতেন তারা।’
বোচাগঞ্জ এলাকার পারুল বেগম জানান, পীরের (ফরহাদ হোসেন) সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধ ছিল না। এলাকায় সবার পছন্দের মানুষ ছিলেন তিনি। সোমবার (১৩ মার্চ) তাকে হত্যার আগে দুটি মোটরসাইকেলে ৫ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকে অনেকেই চলাফেরা করতে দেখেছেন।তারাই এই হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মাহফুজ জামান আশরাফকে প্রধান করে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
উল্লেখ্য, সোমবার (১৩ মার্চ) রাত ৮টার দিকে বোচাগঞ্জ উপজেলার দৌলা নামক এলাকায় কথিত পীর ফরহাদ হাসান চৌধুরী ও তার পালিত মেয়ে রুপালী বেগমকে গুলি ও গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
/এআর/এফএস/বিএল/এসটি/