X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

১৫ বছর ধরে জেনেশুনে বিষপান!

জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা
০৯ অক্টোবর ২০১৭, ০৭:৫৫আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০১৭, ১০:২০

আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত পরিবার, আর্সেনিক থাকার পরও নলকূপ ব্যবহার (ছবি- প্রতিনিধি)

১৫ বছর ধরে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার মজিদের ভিটে গ্রামের মানুষ জেনেশুনে খাওয়ার পানির সঙ্গে আর্সেনিক বিষ পান করছেন।

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সূত্র জানায়, মজিদের ভিটে গ্রামের লোকসংখ্যা প্রায় এক হাজার। এর মধ্যে শতাধিক পরিবারের প্রায় চার শ’ নারী-পুরুষ আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। এদের শরীরে আর্সেনিকের ক্ষত রয়েছে। উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ভাষ্য, এখানে দেড় থেকে দুইশ’ নলকূপ রয়েছে; এর মধ্যে অর্ধশতাধিক নলকূপে আর্সেনিকের সন্ধান মিলে। ১৫ বছর আগে এ নলকূপগুলোর পানিতে আর্সেনিক ধরা পড়ে।

উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, মজিদের ভিটে গ্রামে দিন দিন আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বাড়লেও সচেতনতা বাড়ছে না। তাই গ্রামের বেশিরভাগ নলকূপে আর্সেনিক থাকার পরও তা ব্যবহার করে আসছেন এখানকার বাসিন্দারা।

মজিদের ভিটে গ্রাম গাইবান্ধা শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে। বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) বিকালে এ গ্রামের আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন পুরুষের সঙ্গে কথা হয়, যাদের প্রত্যেকের শরীরে কালো ফোসকা, হাত ও পায়ের তালুতে আর্সেনিকের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। তারা জানায়, অনেক দিন ধরে তারা আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। তাদের অনেকের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরও একই অবস্থা। তাদের অভিযোগ, সরকারি বা বেসরকারিভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ বা তাদের চিকিৎসায় কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

হাতে-পায়ে আর্সেনিকের ক্ষত (ছবি- প্রতিনিধি)

স্থানীয়রা জানান, গত ১৫ বছর আগে অর্ধশতাধিক নলকূপে আর্সেনিকের সন্ধান পাওয়ার পর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদফতর ওই নলকূপগুলোর গায়ে সতর্কীকরণ ‘লাল রং’ দাগ দিয়ে দেয়। ২০০৫ সালে নিরাপদ পানি সরবরাহের জন্য গ্রামে স্থাপন করা হয় পাঁচটি তারা পাম্প।

মজিদের ভিটে গ্রামের ছাইদুর রহমান বলেন, ‘তারা পাম্পগুলো কিছুদিন সচল ছিল। কিন্তু সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় তা বিকল হয়ে পড়ে। এছাড়া দুই-তিন দিন আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তদের ওষুধ দেয় স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। কিন্তু পরে আর ওষুধ পাইনি আমরা।’

সোহেল মিয়া নামে অন্য একজন জানান, আর্সেনিক দেখা দেওয়ার পরও তারা লাল চিহ্ন দেওয়া নলকূপের পানি ব্যবহার করে আসছেন। প্রতিদিন গোসল করা, রান্না, কাপড় ধোয়াসহ সাংসারিক সব কাজ করছেন এসব নলকূপের পানিতে। এছাড়া বিকল্পভাবে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়েই আর্সেনিকযুক্ত পানিই পান করছেন।

আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত আনোয়ার মিয়া বলেন, ‘টিউবয়েলের পানি পান করায় আমার পরিবারের ছয় সদস্যই আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। এর মধ্যে তিন বছর আগে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমার ভাই মারা যায়।’

পরিবারের সবাই আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত (ছবি- প্রতিনিধি)

আল-আমিন মিয়া নামে একজনের অভিযোগ, ‘বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ও আক্রান্তদের চিকিৎসা পেতে বারবার সরকারি কর্মকর্তাদের জানানো হলেও কোনও প্রতিকার মেলেনি। এমনকি, গত ১৫ বছর ধরে এ অবস্থা চললেও কেউ আমাদের খবর নেয়নি।’

পদুমশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তৌহিদুজ্জামান স্বপন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গ্রামের প্রায় চারশ’ মানুষ আর্সেনিকোসিসে আক্রান্ত। বাকিরাও চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন করা হয়েছে।’ শিগগিরই এ গ্রামে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের দাবি জানান তিনি।

গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সিহাব হোসেন বলেন, ‘জেলার আর্সেনিকোসিসে আক্রান্তদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেসহ বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আক্রান্ত রোগীর মধ্যে কারও যদি বেশি সমস্যা হয়, সেক্ষেত্রে তারা সদর হাসপাতালে আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তাদের সঠিক চিকিৎসা দেওয় হবে।’

গাইবান্ধা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহমুদ আলম শাহিন বলেন, ‘২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর থেকে জেলা সদরসহ সাত উপজেলার টিউবয়েলগুলোতে আর্সেনিকের মাত্রা পরীক্ষা করা হয়। তখন জেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর আওতায় প্রায় ২৫ হাজার নলকূপ ছিল। এসব নলকূপ পরীক্ষা করে ৫১৪টি নলকূপে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া যায়। সেময় জেলার আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় তারা পাম্প স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেগুলো এখন অকেজো হয়ে পড়ে আছে। তবে আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে আবারও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে ৪৪টি তারা পাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অল্প সময়ে এসব পাম্প স্থাপন করা হলে অনেকে উপকৃত হবেন।’

গাইবান্ধা সিভিল সার্জন ডা. মো. আমির আলী বলেন, ‘১৫ বছর আগে মজিদের ভিটে গ্রামের নলকূপগুলোতে আর্সেনিকের সন্ধান মিলে। সেসময় প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে আক্রান্তদের ওষুধসহ সেবা দেয় স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। এছাড়া আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য সাঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্মকতাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে যারা বেশি মাত্রায় আক্রান্ত তাদের সদর হাসপাতালে আসার পরামর্শ দিচ্ছি। যে সব এলাকার বেশিভাগ নলকূপে আর্সেনিক রয়েছে, সেসব এলাকার মানুষকে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এজন্য গভীর নলকূপ স্থাপন করলে আর্সেনিকের মাত্রা কমে যাবে।’

/এনআই/এমএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
আজ মধ্যরাত থেকে আগামী ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ
আজ মধ্যরাত থেকে আগামী ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ
জম্মু ও কাশ্মীরে জোড়া হামলা, নিহত ১, দম্পতি আহত
জম্মু ও কাশ্মীরে জোড়া হামলা, নিহত ১, দম্পতি আহত
মিরপুরে অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে চালকদের বিক্ষোভ
মিরপুরে অটোরিকশা বন্ধের প্রতিবাদে চালকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
৩০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির দাবি তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের
‘নীরব’ থাকবেন মামুনুল, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
‘নীরব’ থাকবেন মামুনুল, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক