মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংস ঘটনার পর যেসব রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের বড় একটি অংশ শিশু। তাদের অনেকেরই পরিবারের কোনও সদস্যই বেঁচে নেই। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পথে তাদের পোহাতে হয়েছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। ক্ষুধা-তৃষ্ণা চূড়ান্ত অযত্নে থাকা এসব শিশু রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে স্বজনদের ফিরে না পেলেও নিয়মিত পাচ্ছে খাবার, পেয়েছে আশ্রয়। আর তাই কিছুটা হলেও হাসি ফুটেছে এসব স্বজনহীন শিশুদের মুখে।
জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া শিশুদের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। এর মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ পর্যন্ত ১২ হাজার ৮০১ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) বেশ কয়েকটি শিশুর সঙ্গে সময় কাটান এই প্রতিবেদক।
কেমন আছো, জানতে চাইলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা বস্তির স্বজনহারা শিশু মো. ইব্রাহিম, মাজেদ, ফরিদ, তাহের, নুরুল ইসলাম, শারমিনা, ফাতেমা ও নূর নাহার এক বাক্যে জানায়, তারা বেশ ভালো আছে। প্রতিদিন তিন বেলা খাবার খেতে পারছে। ত্রাণ হিসেবে দেওয়া বিস্কুট, কলা, মুড়িও আসছে তাদের হাতে। অসুস্থ হলে দ্রুত চিকিৎসাসেবাও মিলছে বলে জানায় তারা।
এতিম রোহিঙ্গা শিশুরা জানায়, তাদের অনেকেই রাখাইনেই হারিয়েছে মা-বাবা-ভাই-বোনকে। কারও কারও স্বজনরা মারা গেছে বাংলাদেশে আসার পথে। কেউ কেউ জানে না, তাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনদের কে কোথায় আছে। এসব শিশুদের অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রওনা হয়েছিল বাংলাদেশের পথে। কিন্তু পথেই সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সবার থেকে। তবে তাদের বড় অংশই রাখাইন থেকেই হারিয়েছে স্বজনদের সবাইকে। প্রাণ বাঁচাতে তারা প্রতিবেশী বা স্থানীয়দের সঙ্গে রওনা দেয় বাংলাদেশের পথে।
আনুমানিক ১০ বছর বয়সী কিশোর মাজেদ জানায়, রাখাইনেই তার বাবা-মা মারা যায়। পরে গ্রামের সবাই রওনা দিলে সবার সঙ্গে সে-ও রওনা দেয় বাংলাদেশের পথে। সাত-আট দিন ধরে হেঁটে, নদী পেরিয়ে সে অন্যদের সঙ্গে চলে আসে বাংলাদেশে।
ফাতেমা নামের আরেক মেয়ে জানায়, তার বাবা-মাকে সেনাবাহিনী মেরে ফেলেছ। ছোট এক ভাই ছিল; সেও মারা গেছে সেনাবাহিনীর নির্যাতনে। পরে সে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে চলে আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিশুদের নিবন্ধন, খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, টেকনাফে প্রবেশের পর তাদের ক্যাম্পে পাঠানো, নিরাপত্তা দেওয়াসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালীর শফিউল্লাহ কাটা, টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদাসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজগুলোও করছে সেনাবাহিনী। ক্যাম্পগুলোতে শিশুদের দিকে বিশেষ নজর রাখছেন তারা।
কক্সবাজার সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিশুর সংখ্যা কত, ঠিক জানা নেই। তবে সমাজসেবা অধিদফতর এতিম শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। এ পর্যন্ত ১২ হাজার ৮০১ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে। এখনও রোহিঙ্গারা আসতে থাকায় এতিম শিশুর সংখ্যা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ এতিম শিশুরা যেন খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা সঠিকভাবে পেতে পারে, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
এদিকে, বৃহস্পতিবার রাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সম্মেলনকক্ষে রোহিঙ্গা বিষয়ক সমন্বয় কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক কবির বিন আনোয়ার জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা শিশুকে এতিম হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এসব শিশুকে বিশেষ একটি সুরক্ষা অঞ্চলে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।