X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ বছর ধরে পুলিশ সদস্যদের উত্ত্যক্তের শিকার স্কুলছাত্রীরা!

হেদায়েৎ হোসেন, খুলনা
১০ জানুয়ারি ২০১৮, ২২:৫০আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০১৮, ০৮:১০

বাইনতলা এলাকার ফাঁড়িতে অবরুদ্ধ পুলিশ সদস্যরা (ফাইল ছবি)

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার খারাবাদ বাইনতলা এলাকার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যদের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছর ধরে উত্ত্যক্তের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী স্কুলছাত্রীদের অনেকে। এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, শুধু স্কুলছাত্রীই নয়; ফাঁড়ির আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ির মেয়ে, গৃহবধূদেরও পুলিশ সদস্যরা উত্ত্যক্ত করেছেন।


স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) বিকালে খারাবাদ বাইনতলা এলাকার ফাঁড়ির ১২ জন পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড (প্রত্যাহার) করে জেলা পুলিশ লাইন্সে নেওয়া হয়। এ ঘটনার ব্যাপারে ভুক্তভোগী ছাত্রী ও স্থানীয় লোকজন এসব অভিযোগ করেন।
খারাবাদ বাইনতলা স্কুলের ভুক্তভোগী অনেক ছাত্রীর অভিযোগ, তাদের স্কুলের ঠিক পেছনে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়। আর ইউপি কার্যালয়ে মধ্যে রয়েছে পুলিশের অস্থায়ী ফাঁড়ি। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে ওই ফাঁড়ি থেকেই পুলিশ সদস্যরা ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করতেন। গত পাঁচ বছরে ওই ফাঁড়িতে যত পুলিশ সদস্য এসেছেন, তাদের সবার বিরুদ্ধে উত্ত্যক্তের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীরা।
উত্ত্যক্তের শিকার বেশ কয়েকজন ছাত্রী দাবি করেন, স্কুলের পুকুর ও টিউবওয়েল ব্যবহার করতেন ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। এই সুযোগে পুলিশ সদস্যরা পুকুর বা টিউবওয়েলে যাওয়া ছাত্রীদের উদ্দেশে আজেবাজে মন্তব্য করতেন। ফাঁড়ির জানলা দিয়ে স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির ক্লাসরুম স্পষ্ট দেখা যায়। এই সুযোগে ফাঁড়ির জানালা থেকে পুলিশ সদস্যরা ছাত্রীদের উদ্দেশে বাজে ইঙ্গিত ও অঙ্গভঙ্গি করতেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, স্কুলের পুকুরে গোসল বা অন্য কোনও কাজে গেলে খারাবাদ বাইনতলা এলাকার গৃহবধূ ও তরুণীদেরও উত্ত্যক্ত করতেন পুলিশ সদস্যরা। গ্রামের অনেকেই ব্যাপারটা জানতেন। কিন্তু ভয়ে এ নিয়ে মুখ খুলতেন না।
স্থানীয়দের দাবি, স্কুলের পুকুরে গেলে এলাকার তরুণীদের একসঙ্গে গোসল করার প্রস্তাব দিতেন পুলিশ সদস্যরা। গৃহবধূ বা তরুণী ছাড়াও এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদেরও উত্ত্যক্ত করতেন ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। পুকুর বা টিউবওয়েলের আশেপাশে কোনও মেয়েকে দেখলেই সেখানে ছুটে যেতেন ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা। ফাঁড়ির পাশ দিয়ে কোনও মেয়ে গেলে পুলিশ সদস্যরা বাজে মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি করতেন।
ঘটনার শিকার দশম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন,‘ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই আমি পুলিশ সদস্যদের নানান বাজে কথা শুনে আসছি। ছোট হওয়ার কারণে সব কথার মানে বুঝতে পারতাম না। কিন্তু এখন পারি। স্কুল থেকে কোচিংয়ে যাওয়া-আসার পথে ওই ফাঁড়ি পড়ে। ওই পথে গেলেই নানা বাজে মন্তব্য শুনতে হয়। আর স্কুলের পাশের টিউবওয়েলে গেলেও পুলিশ জানালা দিয়ে একইভাবে বাজে মন্তব্য করে।’
একই শ্রেণির অন্য এক ছাত্রী বলেন,‘সামনে পড়ে গেলেই পুলিশ সদস্যরা আমাকে খারাপ কথা বলতো। স্কুলে যাওয়ার পথে শিষ দিতো। পানির জন্য টিউবওয়েলে গেলে পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছুটে আসতো। তারপর আমাদের উদ্দেশ করে শুরু হতো তাদের বাজে বাজে কথাবার্তা।’
একই কথা জানান নবম শ্রেণির আরও এক ছাত্রী। তিনি বলেন, ‘পুকুর বা টিউবওয়েলে গেলে পুলিশ সদস্যদের বাজে কথা শোনা লাগতোই। এমনকি, ক্লাসরুমেও শান্তিতে বসে থাকা যেতো না, ফাঁড়ির জানালা দিয়ে তারা (পুলিশ সদস্যরা) বাজে অঙ্গভঙ্গি করতো।’
খারাবাদ বাইনতলা স্কুলের অদূরে অবস্থিত শুভেচ্ছা কিন্ডারগার্ডেন নামের এক কোচিং সেন্টারের পরিচালক আলী আহমেদ জানান, ছাত্রী ছাড়াও এলাকার সাধারণ তরুণীদের প্রতিনিয়তই উত্ত্যক্ত করতো পুলিশ সদস্যরা। ভয়ে কেউ কোনও অভিযোগ করতো না। বিভিন্ন সময় এ নিয়ে বটিয়াঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে অভিযোগ করা হয়। ওসি ফাঁড়ির ইনচার্জকে অবহিত করলেও ফাঁড়ির ইনচার্জ অভিযোগ আমলে নিতেন না। বরং অভিযোগ দেওয়ার কারণে এলাকার মানুষকে নানাভাবে ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা অহেতুক হয়রানি করতেন।’
খারাবাদ বাইনতলা স্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. আতিয়ার রহমান বলেন,‘দুই বছর আগেও একবার এক পুলিশ সদস্যর বিরুদ্ধে স্কুলের মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ উঠে। ওই সময় এ অভিযোগ নিয়ে জোরেশোরে বাদ-প্রতিবাদ শুরু হলে ওই পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়। কিন্তু ছাত্রী উত্ত্যক্তকরণ বন্ধ হয়নি।’
অধ্যক্ষ আবুল কাশেম বলেন,‘মাঝে লিখিত বা মৌখিক কোনও প্রকার অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখন আবার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় পুলিশই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে।’ তিনি দাবি করেন, ফাঁড়ি প্রত্যাহার করা হলে এলাকার মানুষই নিরাপত্তা সমস্যায় পড়বে।
বটিয়াঘাটা থানার ওসি মোজাম্মেল হক জানান,‘অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের ক্লোজড করা হয়েছে। ফাঁড়িতে ১৪ জন নতুন পুলিশ সদস্য এসেছেন। মঙ্গলবারের ঘটনা তদন্তের জন্য পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বি সার্কেল) সজিব খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের পর পুলিশ সুপারই প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।’
উল্লেখ্য, স্কুলে যাওয়ার পথে মঙ্গলবার দুপুরে তারেক মাহমুদ নামের স্থানীয় এক দোকানদারের বোনসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করেন খারাবাদ বাইনতলা এলাকার পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা। বিষয়টি জানতে পেরে অভিযোগ করার জন্য তারেক ওই ফাঁড়িতে যান। কিন্তু ইনচার্জ ফাঁড়িতে না থাকায় নায়েক জাহিদ ও কনস্টেবল জাহিদসহ ৫ পুলিশ সদস্যের কাছে উত্ত্যক্তের ব্যাপারটি জানতে চান। পরে ইনচার্জ ফিরলে আবার এসে অভিযোগ জানাবেন বলে জানিয়ে নিজের দোকানে ফিরে আসেন তারেক। এর বেশ কিছু সময় পর ফাঁড়ির পুলিশ সদস্যরা তারেককে ডেকে পাঠান। কিন্তু কাজ শেষ করে দোকান থেকে তারেকের বের হতে সময় লাগে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যরা দোকানে এসে তারেককে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করেন। এর আগে দোকানে ভাঙচুর করেন। তারেককে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন পুলিশ ফাঁড়িতে জড়ো হন এবং ওই পুলিশ সদস্যদের অবরোধ করেন। পরে ওই ফাঁড়ির ১২ পুলিশ সদস্যকে ক্লোজড করে জেলা পুলিশ লাইন্সে নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন–

স্কুলছাত্রীদের উত্ত্যক্তের অভিযোগে ১২ পুলিশ সদস্য ক্লোজড

/এমএ/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
নিষ্পত্তির অপেক্ষায় হেফাজতের ২০৩ মামলা
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ