উপাচার্য হিসেবে ফারজানা ইসলামের পুনর্নিয়োগকে কেন্দ্র করে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দু’পক্ষের চলমান দ্বন্দ্বে অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই দ্বন্দ্বে উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এবং সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির উভয়েই বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেতে চাচ্ছেন। এরইমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ উপাচার্যের পাশে থাকার ঘোষণা দিলেও অন্য রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো নিরপেক্ষ অবস্থানে রয়েছে। তারা শিক্ষকদের এই রেষারেষিকে সমালোচনার চোখেই দেখছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, উপাচার্যের পুনর্নিয়োগকে কেন্দ্র করে বছরের শুরুতেই আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন দেখা দেয়। উপাচার্য ফারজানা ইসলাম এবং সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির এই দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েন শিক্ষকরা। উপাচার্য গত ১১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়টি আবাসিক হলে প্রভোস্ট পদে পরিবর্তন আনলে এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়। যা দু’পক্ষের শিক্ষকদের হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়। এরপর থেকে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করছে উভয়পক্ষ।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের সমর্থন পেতে মরিয়া শিক্ষকদের দুইপক্ষই। তারা নমনীয় অবস্থানে থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময়, গণসংযোগের মাধ্যমে জনমত গঠন করতে চাইছেন। তবে জাকসু নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা, র্যাগিং, সেশন জট, আসন সংকট, শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতাসহ বিভিন্ন ছাত্র স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দু’পক্ষের প্রতিই ক্ষোভ রয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের পাশে পেতে বৃহস্পতিবার (১৯ এপ্রিল) উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বৃহস্পতিবার বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করেন। বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে শাখা ছাত্রলীগের ৪০-৫০ জন নেতাকর্মীর সঙ্গে বসেন ফারজানা ইসলামের অনুসারী শিক্ষক-কর্মকর্তারা। সভার শুরুতেই উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। পরে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি মো. জুয়েল রানা বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষকদের দুটি সংগঠন থাকা দুঃখজনক। আমরা আপনার পাশে আছি। যেকোনও সময় ছাত্রলীগকে ডাকলে আপনার পাশে পাবেন। না ডাকলেও আমরা আপনার পাশে থাকবো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে এখানে নিয়োগ দিয়েছেন। আপনি যাতে এখানে নিশ্চিতে থাকতে পারেন সেজন্য আমাদের ক্ষতি হলেও ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা কাজ করবো।’ ভবিষ্যতে উপাচার্যকে ছাত্রলীগের পাশে পাওয়ার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।
সভার সমাপনী বক্তব্যে আত্মসমালোচনা করে উপাচার্য বলেন, ‘আমার দুঃখ হচ্ছে এজন্য যে আমি কেন ছাত্রলীগের ক্ষোভ, হতাশার সময়গুলোতে পাশে থাকতে পারিনি! আমি কি এতটাই অবহেলা করেছি যে ছাত্রলীগের ভালো কাজগুলো বুঝতে পারিনি! তবে এখন বোঝার দরকার আছে। দেশ যখন ডাকে, ছাত্রলীগ তখন সাড়া দেয়। আমার ডাকেও যে তোমরা আসবে সেটা আমি জানি।’
এরপর রাত পৌনে আটটায় উপাচার্য ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, সাংস্কৃতিক জোট, জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ, সাংবাদিক সমিতির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিমিয় করেন। এ সময় সহকর্মীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শাস্তি পাওয়া এক শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েন উপাচার্য।
তখন উপাচার্য বলেন, ‘ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এসেছিল তাতে আরও বড় শাস্তি হতে পারতো। কিন্তু অভিযোগ দায়েরের পর অভিযোগকারী তার ওপর সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। অভিযোগকারী নিজ আগ্রহে নানা কাজে ওই শিক্ষককে সহযোগিতা করেছেন, যোগাযোগ করেছেন। তারা একটি ভালো সম্পর্কের মধ্যে ছিলেন।’
এছাড়া জাকসু নির্বাচন, র্যাগিং, হলে আসন বণ্টনে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণহীনতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমালোচনা করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের হাতাহাতির ঘটনায় দু’পক্ষেরই তীব্র সমালোচনা করেন শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, গত বুধবার (১৭ এপ্রিল) সংবাদ সম্মেলনে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের ঘোষণা দিয়েছে শরীফ এনামুল কবিরপন্থী শিক্ষকরা। তাদের মুখপাত্র দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফরিদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশীদার শিক্ষার্থীদের কাছে আমরা আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও যৌক্তিকতা তুলে ধরব। তাদের কথা শুনবো। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত আমরা যেসব কর্মসূচি দিয়েছি তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাধ্য না করলে আমরা কঠোর কর্মসূচিতে যাবো না।’
তিনি জানান, শুক্রবার-সোমবার এই চারদিন তারা ক্যাম্পাসে গণসংযোগ করবেন। এরমধ্যে রবি ও সোমবার জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অফিসে ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করা হবে।
যা বলছে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো
চলমান পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ একটি পক্ষ নিলেও বাম ঘরানার সংগঠনগুলো নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে একই সুরে কথা বলছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থিতিশীল দেখতে চাইছেন তারা।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের জাবি সংসদের সভাপতি ইমরান নাদিম বলেন, ‘কিছু দিন আগেও একাট্টা থাকা শিক্ষকরা ক্ষমতার দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ক্ষমতার যে কাঠামো সেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। লেজুড়বৃত্তি ছেড়ে ক্যাম্পাসকে স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব শিক্ষকদেরই।’
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মোহম্মদ দিদার বলেন, ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্বেই শিক্ষকদের এই রেষারেষি। জাকসু নির্বাচন দিয়ে সিনেট পূর্ণ করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় এমন কোনও কর্মকাণ্ড আমরা সমর্থন করব না।’ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে অগণতান্ত্রিক ধারা চলে আসছে তার ফল আজকের এই দ্বন্দ্ব’ বলে উল্লেখ করেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহাথির মোহাম্মদ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আশিকুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি বিভাগে পরীক্ষা চলছে। আমরা কোনও অস্থিতিশীল পরিবেশ দেখতে চাই না। আমরা কোনও পক্ষের নই।’