X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

খুলনা জিআরপি থানা হাজতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্তরা এখনও বহাল তবিয়তে

মো. হেদায়েৎ হোসেন, খুলনা
০৬ আগস্ট ২০১৯, ২০:১২আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০১৯, ২০:৫৪

খুলনা জিআরপি থানা খুলনা জিআরপি থানা হাজতে এক নারীকে (৩০) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত ওসিসহ অন্যরা এখনও বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। অভিযোগ প্রকাশ্যে আসার পর দুইদিন পার হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় পর্যায়ের কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। তারা বহাল থাকায় তদন্ত কার্যক্রম প্রভাবিত করতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা।

এদিকে সংঘবদ্ধ এই ধর্ষণের অভিযোগে গঠিত তিন সদস্যের টিম তদন্ত শুরু করেছে। মঙ্গলবার বিকালে কুষ্টিয়া রেলওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার ফিরোজ আহমেদের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা খুলনা জিআরপি থানা পরিদর্শন এবং তদন্ত শুরু করেন। এ সময় তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলেন, আমরা কেবল তদন্ত শুরু করেছি। এখনই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব না। তবে ভিকটিমের স্বজনরা জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটি এখনও তাদের সঙ্গে কথা বলেনি।

অপরদিকে, থানা হাজতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় খুলনার বিভিন্ন মহলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং জড়িতদের কঠিন শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার মহানগরীর পিকচার প্যালেস মোড়ে এ কর্মসূচি পালিত হয়। খুলনা জিআরপি থানার হাজতখানা

পাকশী রেলওয়ে জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম জানান, ‘ঘটনার সঠিক তথ্য উদঘাটনের লক্ষ্যে তিন সদস্যের কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। তদন্ত কমিটিকে ঘটনাটি সরেজমিন অনুসন্ধান করে সুস্পষ্ট মতামতসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন সাত দিনের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে দোষিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

ধর্ষণের অভিযোগ তোলা ওই নারীর বড় বোন বলেন, ‘রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বা রেল পুলিশের তদন্ত কমিটির কোনও সদস্য আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। তারা কীভাবে তদন্ত করছেন তা বলতে পারবো না। তবে অভিযুক্ত ওসি উছমান গণি পাঠানসহ অন্য পুলিশ সদস্যদের বহাল তবিয়তে রেখে তদন্ত কার্যক্রম চালানো হলে তারা প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে।’

বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূকে আদালত ফেনসিডিল মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছেন। ২/১ দিনের মধ্যে আবারও তার জামিনের আবেদন করা হবে। তবে ধর্ষণের ফরেনসিক রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে আদালতের পরবর্তী সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনার জিআরপি থানায় একটি মাত্র হাজতখানা রয়েছে। এখানে নারী হাজতি রাখার জন্য পৃথক সেল নেই। ঘটনার রাতে ভিকটিমকে থানার একমাত্র হাজতখানায়ই রাখা হয় বলে পুলিশ দাবি করছে।

ধর্ষণের অভিযোগ ওঠা খুলনা জিআরপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উছমান গনি বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেন, ‘থানায় হাজতখানা একটিই। পুরুষ হাজতি থাকলে মহিলা হাজতিদের থানার অন্য কক্ষে রাখা হয়। ২ আগস্ট ঘটনার রাতে থানায় ওই নারীই একমাত্র হাজতী ছিলেন। আর তাই তাকে থানার হাজতখানায়ই রাখা হয়েছিল।’ তিনি আরও দাবি করেন, 'ওই রাতে থানায় দুই জন নারী কনস্টেবল, সেন্ট্রি হিসেবে দুই জন পুরুষ কনস্টেবল, ডিউটি অফিসারসহ নিয়মিত ডিউটির অন্যান্য কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যও ছিলেন। ধর্ষণের অভিযোগ সত্যি নয়।' খুলনা জিআরপি থানা ভিকটিমের দুলাভাই অভিযোগ করেন, তার শালিকার বাড়ি খুলনা মহানগরীতেই। তার শ্বশুরবাড়ি সিলেটে। তার তিনটি সন্তান আছে। ২ আগস্ট বিকালে এই নারী যশোরে ডাক্তার দেখাতে যান। এরপর বাড়ি আসার জন্য বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনে ওঠে। ট্রেনটি ফুলতলা এলাকায় পৌঁছালে ট্রেনে থাকা জিআরপি পুলিশ মোবাইল চুরির অভিযোগ তুলে তাকে আটক করে। এরপর তাকে খুলনা জিআরপি থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনি আরও অভিযোগ করেন, ২ আগস্ট ঘটনার রাতে খুলনা জিআরপি থানায় ছিলেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উছমান গনি পাঠান, এসআই গৌতম কুমার পাল, এসআই নাজমুল হাসান, কনস্টেবল মিজান, হারুন, মফিজ, আব্দুল কুদ্দুস, আলাউদ্দিন, কাজল, দুই নারী কনস্টেবলসহ বেশ কয়েকজন। ওই রাতে গৃহবধূকে ওসি উছমান গনি পাঠানসহ পাঁচ পুলিশ সদস্য শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এরপর থানা হাজতে রেখেই ওসি আগে তাকে ধর্ষণ করে। পরে পুলিশের অন্য চার সদস্য তাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে।

ভিকটিমের বড় বোন অভিযোগ করেন, ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ওসি ওসমান গনি রবিবার রাতে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সামনে এসে তাদের দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার প্রস্তাব দেন। কিন্তু তারা সমঝোতায় রাজি না হওয়ায় তিনি দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে চলে যান।

খুমেক হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ও ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়কারী ডা. অঞ্জন কুমার চক্রবর্তী জানান, ডাক্তারি পরীক্ষা করাসহ নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। ধর্ষণের আলামত আছে কিনা সে বিষয়ে তিনি মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, ‘ফরেনসিক বিভাগের তিন জন চিকিৎসকের সমন্বয়ে মেডিক্যাল বোর্ড এ রিপোর্ট তৈরি করবেন। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা যাবে না।’

এদিকে, জনউদ্যোগ খুলনার আয়োজনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, নারীকে নিরাপদে চলাচলের সুযোগ করে দিতে হবে। কোনোভাবে নারী যেন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন না হন। নারী কোনও অপরাধে জড়িত হলে তাকে নিয়ম অনুযায়ী জেরা করতে হবে। কোনোভাবেই যেন শরীরিক নির্যাতনের শিকার না হন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রেলওয়ে পুলিশ রেলযাত্রীদের নিরাপত্তা দেওয়ার পরিবর্তে এক নারীকে থানায় আটকে রেখে ওসিসহ পাঁচ পুলিশের ধর্ষণের যে অভিযোগ উঠেছে, এরচেয়ে আর জঘন্য কোন কাজ হতে পারে না। তাই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তদন্তের সুবিধার্থে অভিযুক্তদের পদ থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কোনোভাবে যেন আসামিরা এই অভিযোগটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিএমএ সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলমের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন জাসদ নেতা মো. খালিদ হোসেন, সিপিবি মহানগর কমিটির সভাপতি এইচএম শাহাদাৎ, নারীনেত্রী অ্যাডভোকেট শামীমা সুলতানা শিলু, নারীনেত্রী সিলভী হারুণ, মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম, ওয়ার্কার্স পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কমরেড মফিদুল ইসলাম, সিপিবির জেলা কমিটির নেতা মিজানুর রহমান বাবু, ন্যাপ নেতা তপন রায়, টিআইবি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার ফিরোজ উদ্দিনসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছসেবী ও নাগরিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। মানববন্ধন পরিচালনা করেন জনউদ্যোগের সদস্য সচিব সাংবাদিক মহেন্দ্রনাথ সেন।

উল্লেখ্য, ২ আগস্ট যশোর থেকে ট্রেনে খুলনায় আসার পথে খুলনা রেলস্টেশনে কর্তব্যরত জিআরপি পুলিশের সদস্যরা ওই গৃবধূকে মোবাইল চুরির অভিযোগে আটক করে। পরদিন শনিবার তাকে পাঁচ বোতল ফেনসিডিলসহ একটি মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে খুলনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলি আদালত ফুলতলায় পাঠানো হয়। ৪ আগস্ট আদালতে জামিন শুনানিকালে ওই নারী অভিযোগ করেন, জিআরপি থানায় তিনি সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এরপর আদালতের নির্দেশে সোমবার তার ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। এ ঘটনায় পাকশী রেলওয়ে জেলা পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের নির্দেশে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আরও পড়ুন- 

খুলনায় রেলওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে তদন্ত কমিটি

খুলনায় জিআরপি থানার ওসিসহ ৫ পুলিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহত বেড়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার
যাত্রাবাড়ীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৫
যাত্রাবাড়ীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৫
‘কালি ও কলম’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন চার তরুণ
‘কালি ও কলম’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন চার তরুণ
দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে ২ জন নিহত
দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে ২ জন নিহত
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে