X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত নেতা সাদিকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি
০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ১৮:০৭আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ২০:২৪




সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিক সাতক্ষীরার কালীগঞ্জে বিকাশের ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ সাদিকুর রহমান সাদিককে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে উল্লেখ করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় ছাত্রলীগ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। ছিনতাইয়ের ঘটনা তদন্তের সময় গত ২৯ নভেম্বর রাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় সাদিকের দুই দেহরক্ষী ও অস্ত্রধারী ক্যাডার সাইফুল ইসলাম ও মামুনুল ইসলাম। এরপর সাদিক ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা। তাদের বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমিদখল এবং যৌন হয়রানির মতো একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পুলিশ জানিয়েছে, বন্দুকযুদ্ধে দুই অনুসারী নিহতের পর ছিনতাই হওয়া ২৬ লাখ টাকার ২২ লাখ নিয়ে বর্তমানে গা ঢাকা দিয়েছে সাদিক।

ছাত্রলীগের স্থানীয় নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী জানায়, চাচা সদর আসনের সংসদ সদস্য এবং নিজে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় সাদিক কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে দাপটের সঙ্গে বিভিন্ন অপকর্ম করে গেছে।

সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে সাদিক বাহিনীর সদস্যদের থানায় প্রবেশ করে পুলিশ সদস্যদের লাঞ্ছিত করারও চিত্র দেখা গেছে। শুধু পুলিশ নয়, জেলায় কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকরাও সাদিক বাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। গত ৩০ মে সাতক্ষীরা প্রেস ক্লাবে দ্বীপ-সাইফুলসহ অন্য সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায় সাদিক।

সাদিকের কুকর্মের ফিরিস্তি দিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের একাধিক নেতা। তারা বলেন, সাদিক ছাত্রলীগের কোনও পদেই ছিল না। তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতাদের মোটা অংকের টাকা, মাছ, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও মধু দিয়ে সে সাধারণ সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেয়। তাকে সাধারণ সম্পাদক হতে সাহায্য করেন তার চাচা ও সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। জেলা সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে সাদিক ও তার অনুসারীরা। অনুসারীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের মাধ্যমে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, দখল এবং টেন্ডারবাজি করিয়ে টাকার ভাগ নিতো সাদিক।

ছাত্রলীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাদিক ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আসে। এই টাকা তুলতে সে জেলাব্যাপী উপজেলা কমিটি গঠনের নামে নেতাকর্মীদের থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এমনকি কমিটি বহাল রাখার কথা বলেও টাকা নিয়েছে সে।

সাদিকের যৌন লালসার শিকার হয়ে অনেক মেয়ে সাতক্ষীরা ছেড়ে পালিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন মুনজিতপুর এলাকার এক বাসিন্দা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সন্ত্রাসী সাদিক ও তার দেহরক্ষীদের কারণে শহরের সরকারি মহিলা কলেজ ও নবারুণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েরা নিরাপদে যাতায়াত করতে পারতো না। কখন তার বাহিনী কার হাত ধরে টানে, কিংবা উত্ত্যক্ত করে, এমনকি তুলে নিয়ে যায়, এমন আতঙ্কে থাকতেন অভিভাবক ও ছাত্রীরা। সাদিকের যৌন লালসার শিকার হয়ে অনেক মেয়ে সাতক্ষীরা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

সাদিক ও তার দেহরক্ষী সাইফুল কতো মেয়ের সর্বনাশ করেছে, তার হিসাব নেই বলে জানিয়েছে তারই ঘনিষ্ঠ কর্মীরা। মুন্সিপাড়ার সোহাগ নামের স্কুল দফতরিও নারীঘটিত বিষয়ে খুন হয়েছিল বলেও জানান তারা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সে (সাদিক) ছাত্রলীগ নেতা হয়েও আওয়ামী লীগ নেতার জমি দখল করেছে। গত ৩ আগস্ট পৌরসভার-২ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি আইয়ুব আলীর নিঃসন্তান স্ত্রী হোসনে আরার বাড়িসহ জমি অন্যকে দখল করে দেওয়ার জন্য এলাকায় যায়। তবে ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়লে এলাকাবাসীর তোপের মুখে অসাবধানতাবশত সাদিকের কাছে থাকা পিস্তলের গুলিতে আহত হন তার আরেক সৈনিক পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফারাবি আজমি। ঘটনা ছাইচাপা দিতে প্রচার করা হয়—ওই বাড়িতে শিবির ক্যাডাররা নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদুজ্জামান রাশির জমিও সাদিক দখল করতে চেয়েছিল, তবে সে পেরে ওঠেনি।

ওই আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন, ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ শহরের আলাউদ্দিন চত্বরে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যুবলীগের মনোয়ার হোসেন অনুকে সাদিকের নির্দেশে ছুরিকাঘাত করে দ্বীপ। কিন্তু এতে তার কিছু হয়নি। এরপর দ্বীপ আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের অপর এক নেতা বলেন, গত ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আমিনুর রহমানকে ফোনে ডেকে নেন সাদিক। শহরের প্রাণিসম্পদ অফিসের কাছে নিয়ে সাদিক তার কাছে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এসময় আমিনুর রহমানকে মারপিট ও শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সাদিক ও সাইফুল ওইদিন আমিনুর রহমানের ব্যাংক থেকে ওঠানো দুই লাখ টাকাও কেড়ে নেয়। পরে এ ঘটনায় আমিনুর রহমান থানায় অভিযোগ জানান। ঘটনার বিচার দাবিতে ব্যবসায়ীরা আন্দোলন করলেও, সাদিকের সংসদ সদস্য চাচার চাপের মুখে নির্যাতিত আমিনুর রহমান অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেন।

সাদিক ও তার পরিবারের যত অপর্কম
জেলা আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ হায়দার আলী তোতার ভাতিজা হলো ছাত্রলীগ নেতা সাদিক। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তোতার বাড়ি থেকে একদল জুয়াড়ি ও জুয়ার সরঞ্জাম আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সাদিকের বাড়িতে ছিল শহরের কিছু তরুণীর অবাধ যাতায়াত। এসব নিয়ে গুঞ্জন উঠলেও এলাকাবাসী বা তার পরিবারের পক্ষ থেকে সাদিককে বাধা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। সাদিক ও তার অনুসারীরা পুরোপুরি মাদকাসক্ত বলেও জানিয়েছে তার পরিচিতরা।

সাদিক বাহিনীর সদস্যরা এখন কে কোথায়?
ছিনতাই, জবরদখল, চাঁদাবাজি ও লুটপাটের জন্য একেক এলাকায় সাদিকের একেকজন সেনাপতি ছিল। এর মধ্যে ২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাইফুল ও দ্বীপ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হলেও অনেকে আছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

দ্বীপ, সাইফুল মারা যাওয়ার পর গা ঢাকা দিয়েছে সাদিক বাহিনীর ক্যাডার ফজলে রাব্বি শাওন। তার দায়িত্ব ছিল সদর উপজেলা শাল্যে-মাছখোলা এলাকায় ছিনতাই, জবরদখল, চাঁদাবাজি, লুটপাট করা। ওই টাকার ভাগ পেতো সাদিক।

সাদিকের আরেক ক্যাডার কালাম ও তার অনুসারীদের নাম শুনলে ভয়ে কেঁপে উঠতো সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা। তার বাড়ি শহরের মুনজিতপুর এলাকায় হওয়ায় সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছে সে ছিল মূর্তিমান আতঙ্ক। ‘সাদিক ভাইয়ের ছোট ভাই’ পরিচয়ে সে সরকারি কলেজ মোড় এলাকায় ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে বেড়াতো।

সাদিক বাহিনীর অপর এক সদস্য জামালও গা ঢাকা দিয়েছে। সরকারি কলেজ এলাকায় সেও চাঁদাবাজি ও লুটপাট করতো। প্রাইমারির গণ্ডি না পেরোলেও সাদিকের ছোট ভাই পরিচয়ে সে পুরো এলাকা দাপিয়ে বেড়াতো। লিজ না নিয়েও সরকারি কলেজের পুকুর থেকে মাছ ও বিভিন্ন গাছ থেকে ফল পেড়ে নিতো সে।

সুলতানপুর বড় বাজার এলাকার বকাল সোহাগও এখন পলাতক। সে পশু চোরাচালানে জড়িত ছিল।

রাতের আঁধারে ছিনতাই করাই ছিল সাদিকের অনুসারী তৌকিরের কাজ। তাকে দিনের বেলায় খুব কম দেখা যেতো। বিবাহিত হওয়ার পরেও সে ছাত্রলীগের পরিচয় দিতো। এই তৌকিরের বিরুদ্ধে সরকারি কলেজের অনেক মেয়ের সর্বনাশ করারও অভিযোগ রয়েছে।

সাদিক বাহিনীর দুই সদস্য নাহিদ ও জাহিদ শহরের ইটাগাছা এলাকায় এখনও চাঁদাবাজি করে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া মৃণাল মণ্ডল, নাইম সয়োরার, ফারিব আবির, কাজী সাদিকুর রহমান দ্বীপসহ অনেকেই পলাতক রয়েছে। তাদের সবার ফোনও বন্ধ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সদ্য বিলুপ্ত জেলা কমিটির সভাপতি রেজাউল ইসলাম রেজা বলেন, সাদিকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ আসছে। সে অপরাধ করেছে, তার সাজা তাকে পেতে হবে। আমি কখনও কোনও শিক্ষার্থীর সঙ্গে বাজে আচরণ করিনি। তবে সাদিকের বিরুদ্ধে এমন হাজারো অভিযোগ আছে। সে এবং তার সঙ্গীদের কারণে শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা অতিষ্ঠ ছিল।

এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ বলেন, সাদিকের বিরুদ্ধে আমার কাছে অনেক অভিযোগ এসেছে। তবে ছাত্রলীগ আমাদের কন্ট্রোলে ছিল না। তার কারণে ছাত্রলীগের দুর্নাম হয়েছে। সাদিকের কারণেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তার অপরাধের শাস্তি তাকে পেতেই হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ছাত্রলীগ নেতা সাদিকের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অভিযোগ ও বহিষ্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা সদরের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি বলেন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদিকের বহিষ্কারাদেশের বিষয়টি পত্রিকায় দেখেছি। তবে কী কারণে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে সেটা বলতে পারছি না। এ বিষয়ে আর কিছু বলতে না চেয়ে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।

আরও পড়ুন:

‘বন্দুকযুদ্ধে নিহত দ্বীপ-সাইফুলের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পেতো না’


২৬ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ‘মাস্টারমাইন্ড’ ছাত্রলীগ নেতা সাদিককে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ

সাতক্ষীরা জেলা ছাত্রলীগ সম্পাদকের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা

 

 

/টিটি/এমএমজে/
সম্পর্কিত
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থীর মোটরসাইকেল বহরে বোমা হামলা
সর্বশেষ খবর
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
নির্মোহ মূল্যায়নের খোঁজে জাসদ
সাফজয়ী ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই, নেই কোনও ছাড়
সাফজয়ী ভাইয়ের সঙ্গে লড়াই, নেই কোনও ছাড়
বিয়ে না করানোয় মাকে হত্যা
বিয়ে না করানোয় মাকে হত্যা
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
ব্রাজিলের জার্সিতে এই বছরই শেষ মার্তার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী