X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘কুঁড়েঘর থেকে অট্টালিকায় যাচ্ছি, স্বপ্নের মতো লাগছে’

আবদুল আজিজ, কক্সবাজার
২৩ জুলাই ২০২০, ২০:৪২আপডেট : ২৩ জুলাই ২০২০, ২১:৫৯

গণভবন থেকে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কক্সবাজারে ‘শেখ হাসিনা বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী

বস্তির কুঁড়েঘর থেকে সরাসরি অট্টালিকায়। যেন সিনেমায় দেখা ঘটনা অথবা লটারি বিজয়ী কারও গল্প! তবে এই গল্প একা কারও নয়, এটা বাস্তব ঘটনা এবং কক্সবাজার সাগরপাড়ের জলবায়ু উদ্বাস্তু ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের গল্প। এরইমধ্যে ৬শ’ জনের স্বপ্নপূরণ হয়েছে। তারা আজ পেয়ে গেছেন স্বপ্নের ফ্ল্যাটের চাবি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া বিশেষ এই প্রকল্পের আওতায় তারই উপস্থিতিতে আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচিত ২১ জনের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বুঝে পাবেন ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের জন্য লটারিতে নাম ওঠা বাকি পরিবারগুলোও। আর প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে খুরুশকুলের ‘শেখ হাসিনা বিশেষ আশ্রয়কেন্দ্র’ প্রকল্পের উদ্বোধনের পর এসব উদ্বাস্তু মানুষ নতুন নির্মিত ভবনগুলোতে ফ্ল্যাট পেয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত।

গণভবন থেকে প্রকল্পের উদ্বোধন করে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (ছবি: ফোকাস বাংলা)

কথা হয় বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে ফ্ল্যাটের চাবি পাওয়া ২১ জন উপকারভোগীদের একজন আবু তাহের কুতুবীর সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি যেন স্বপ্নের মতো। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়াসহ উপকূলীয় অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এরপর বাধ্য হয়ে কক্সবাজার সাগরপাড়ে আশ্রয় নেন কুতুবদিয়া, মহেশখালীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকার ৩০ হাজারেরও বেশি উদ্বাস্তু মানুষ। আর কিছু পারতো না তাই এই এলাকার সব মানুষ সাগরপাড়ে মৎস্য আহরণ ও শুঁটকি পল্লিতে কাজ করে আসছিল। বসবাসের এই দীর্ঘ সময়ে কয়েকবার উচ্ছেদ করা হয় আমাদের মতো উদ্বাস্তুদের। কিন্তু, কোনও সরকার পুনর্বাসন করেননি। এদিক ওদিক সরে গিয়ে কোনোমতে টিকে ছিলাম। তবে পুনর্বাসন করেছেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কথা বলছেন উপকারভোগী আবু তাহের কুতুবী

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আবু তাহের কুতুবী বলেন, ‘তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের কথা দিয়ে কথা রেখেছেন। আমাদের উচ্ছেদ না করেই পুনর্বাসন করেছেন। কুঁড়েঘর থেকে অট্টালিকায় যাচ্ছি। সত্যিই এটা স্বপ্নের মতো লাগছে। আমরা সত্যিই আনন্দিত।’

উপকারভোগী জোবাইদা নাসরিন (৩০) জানান, ‘আমরা যারা কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডে অর্থাৎ নাজিরারটেক, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়ায় দীর্ঘদিন বসবাস করে আসছি তারা কোনোদিন কল্পনাও করিনি ফ্ল্যাট পাবো। কারণ, রাজনীতিতে প্রতিশ্রুতির কোনও অভাব নাই। অনেকেই কথা দেয় কিন্তু কথা রাখে না। কিন্তু, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়ে এভাবে এত দ্রুত সেটা বাস্তবায়ন করে দেবেন সে আমাদের ভাবনাতে ছিল না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া প্রার্থনা করছি।’

উপকারভোগী জোবাইদা নাসরিন

একই কথা বলেছেন, খাইরুন্নেছা (৩৫)। তিনি জানান, ‘আশ্রয়কেন্দ্রে ফ্ল্যাট পাওয়াদের অধিকাংশই মৎস্যজীবী। আমরা দীর্ঘদিন ধরে সাগরপাড়ে থাকলেও আমাদের নতুন আবাসস্থল আরও নিরাপদ ও সুন্দর পরিবেশে হয়েছে। বাঁকখালী নদীর পাড়ে এবং সাগরের কাছাকাছি স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র হওয়ায় এখানকার মানুষ মৎস্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ অব্যাহত রাখতে পারবে। তাই, আমাদের জন্য নতুন আবাসস্থল হলেও কোনও ধরনের অসুবিধা হবে না।’

জলবায়ু উদ্বাস্তু বস্তিবাসীদের জন্য কক্সবাজারের শে হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মাণ করা হয়েছে ফ্ল্যাট

উপকারভোগী শাজাব উদ্দিন, ইউছুপ জামান, অংকুর দাশসহ অনেকেই ফ্ল্যাটের চাবি পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। তারা বলেছেন, ১৯৯১-তে ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়িঘর হারানো উদ্বাস্তু মানুষের খবর নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলতে গেলে বস্তির কুঁড়েঘর থেকে দালানে আমাদের ঠিকানা করে দিয়েছেন। অতীতে কোনও সরকার এভাবে করতে পারেনি। এতে আমরা অনেক আনন্দিত ও গর্বিত।

কক্সবাজার নাজিরারটেক শুঁটকি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আতিক উল্লাহ জানান, ‘বৃহস্পতিবার ২১ জনকে ফ্ল্যাটের চাবি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৬শ’টি পরিবার ফ্ল্যাটের মালিকানা বুঝে নেবেন। আমরা যারা এখনও পাইনি, তারা পরবর্তীতে ফ্ল্যাট বুঝে পাবো বলে আশা করছি।’

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের একাংশ

বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) বেলা ১১টার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কক্সবাজারের খুরুশকুলের ‘শেখ হাসিনা বিশেষ আশ্রয়কেন্দ্র’ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। এটিকে ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ বা স্বপ্নের প্রকল্প হিসেবেও অভিহিত করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, ‘কক্সবাজারে বিমানবন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে দেখলাম জলবায়ু পরিবর্তন এবং ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে অনেকে ঘরবাড়ি, ভিটামাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের পুনর্বাসন করবো। সেই চিন্তা থেকেই এই প্রকল্প। এখানে নতুন শহরের মধ্যে মানুষ বসবাস করতে পারবে।’

দুজন উপকারভোগীর হাতে ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেওয়া হচ্ছে। গণভবনে বসে তা দেখছেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি ফ্ল্যাটপ্রাপ্তদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখানে আলাদা একটা সুন্দর শহর গড়ে উঠবে। আপনারা এতদিন যেভাবে ছিলেন কষ্টের মধ্যে, এখন সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারবেন। আপনাদের ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে, বড় হবে। সেটাই আমরা চাই। সেদিকে লক্ষ রেখেই ব্যবস্থা নিয়েছি।’

খুরুশকুলে ফ্ল্যাট উপকারভোগীরা বলছেন, দীর্ঘ ২৯ বছর ধরে সরকার এসে সরকার গেছে। কিন্তু, উদ্বাস্তু এসব মানুষের কোনও ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। খবর নেয়নি কেউ। তবে খবর নিয়েছেন বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন। এভাবে  ফ্ল্যাট পাওয়া অকল্পনীয়।

জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেছেন, ‘কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১০টি বিশেষ অগ্রাধিকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ১৯টি পাঁচতলা ভবনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেখানে বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জলবায়ু উদ্বাস্তু ৬০০ পরিবার পাচ্ছে নতুন ফ্ল্যাট। এগুলো হস্তান্তর শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার ৪৪৮ পরিবার পাবে নির্মিত ফ্ল্যাট’।

দেশে এটিই প্রথম সর্ববৃহৎ এবং সর্বাধিক বাজেটের আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে প্রায় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এ প্রকল্পে ১৩৯টি  ৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। যার মধ্যে শেখ হাসিনা টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা সুউচ্চ ভবনও থাকবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের বাকি ভবনগুলোর কাজও এগিয়ে চলছে। এ প্রকল্পে বসবাসকারী পরিবারগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্কুল, মসজিদ, স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতালসহ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় আশ্রয় পাওয়া মৎস্যজীবীদের কর্মসংস্থানের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে।

ফ্ল্যাটের চাবি তুলে দেওয়া হচ্ছে আরেকজন জলবায়ু উদ্বাস্তুর হতে।

উল্লেখ্য, ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসলীলা হয়। মহেশখালী কুতুবদিয়াসহ উপকূলের বিশাল এলাকা সমুদ্রে বিলীন হয়ে যায়। এতে গৃহহারা হন হাজার হাজার মানুষ। এসব মানুষ জীবনের তাগিদে আশ্রয় নেন কক্সবাজার  বিমানবন্দরের পশ্চিমে বালিয়াড়ী ও ঝাউবাগান এলাকায়। এই এলাকাটি পরে কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে রূপান্তরিত হয়। এখানে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু বসবাস করছেন।

এদিকে কক্সবাজারকে বিশ্বমানের পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছে। শিল্প বিকাশ ও ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে। আর ঝাউবাগানটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে সৃজিত হওয়ায় এটি রক্ষায়ও সরকার বদ্ধপরিকর। এই বিমানবন্দর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরাটেক এবং সমিতিপাড়া এলাকার বিপুল পরিমাণ ভূমি অধিগ্রহণ করে সরকার। অধিগ্রহণের আওতায় পড়া জমিতে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার বাস করতো। ২০১১ সালে ৩ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে এক জনসভায় এসব জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য পুনর্বাসনের নির্দেশনা দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে গ্রহণ করা হয় খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্প। যার নাম দেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্প।

 

/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পাঁচ মাস পর অবশেষে মুক্তির বার্তা
পাঁচ মাস পর অবশেষে মুক্তির বার্তা
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
এমপিপুত্র প্রার্থী হওয়ায় ‘আগুন জ্বলছে’ সেলিম প্রধানের গায়ে
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
ব্রাজিলিয়ানের গোলে আবাহনীতে স্বস্তি
স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভস্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
সর্বাধিক পঠিত
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!