X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘ভুয়া’ মাদ্রাসায় নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ

সাজ্জাদুর রহমান সাজ্জাদ, পঞ্চগড়
১১ আগস্ট ২০২০, ১৯:২৭আপডেট : ১১ আগস্ট ২০২০, ২২:৩৫

ডুবানুচী বরকতিয়া ও শুরিভিটা স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার নামে এই দুটি ঘর তোলা হয়

পঞ্চগড় সদর উপজেলার দুটি মাদ্রাসায় নিয়োগের নামে একটি চক্র প্রায় ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়- জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কারিগরি ও মাদ্রারাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার যে তালিকা পাঠানো হয়েছে; সেই তালিকার শুরুতেই জালিয়াতি করে ওই দুটি মাদ্রাসার নাম যোগ করা হয়েছে।

সরেজমিন জানা যায়, পঞ্চগড় সদর উপজেলার সাতমেরা ইউনিয়নের ডুবানুচী গ্রামে ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি ১৯৯৪ সালে দাখিল পর্যন্ত একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার ২০ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের খারুয়া গ্রামে হুবহু একই নামে আরেকটি মাদ্রাসা গড়ে তোলে একটি চক্র। অপরদিকে পঞ্চগড় সদর উপজেলার পঞ্চগড় ইউনিয়নের শুরিভিটা গ্রামে ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা। মাদ্রাসাটি ২০০১ সালে দাখিল পর্যন্ত একাডেমিক স্বীকৃতি পায়। তখন নামেও একটু পরিবর্তন আনা হয়। নাম দেওয়া হয় শুরিভিটা দাখিল মাদ্রাসা। কিন্তু ২০১৯ সালে এই মাদ্রাসা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলার কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের বন্দেরপাড়া গ্রামে 'শুরিভিটা হাসনায়নীয়া নজিরিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসা' নামে আরও একটি স্বতন্ত্র মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বতন্ত্র এবতেদায়ী থেকে দাখিলে উন্নিত হওয়ার পর ওই চক্রটি মাদ্রাসা দুটির হুবহু নাম ও বিভিন্ন কাগজপত্র জালিয়াতি করে নতুন করে অন্য এলাকায় দুটি মাদ্রাসা স্থাপন করে। তবে বিতর্ক এড়ানোর জন্য নতুন করে স্থাপন করা মাদ্রাসায় কোনও নামফলক স্থাপন করেননি। রাস্তার পাশে ফসলি জমিতে ছোট্ট করে টিনের বেড়া দিয়ে ঘর তোলা হয়েছে। এখানে কোন ক্লাসও হয় না। শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থী কারও দেখা পাওয়া যায়নি। ভুয়া মাদ্রাসা দুটির পক্ষে যেসব কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই জাল। জমি রেজিস্ট্রির দলিলটিও জাল। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও মাদ্রাসা দুটির প্রতিষ্ঠাকাল দেখানো হয়েছে ১৯৬৫ সাল। পুরনো পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রিন্টের কারসাজি করে দেওয়া হয়েছে শিক্ষক নিয়োগ। প্রতিটি শিক্ষকের কাছে নেওয়া হয়েছে তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। এছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তারা ব্যানবেইসে ভুয়া তথ্য সরবরাহ করেছে। ৬টি আধাপাকা কক্ষ সম্বলিত ভবনের কথা উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে একটি তিন কক্ষের টিনশেড ও টিনের বেড়ার ঘর ছাড়া কিছু দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীদের যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, সেটিও কেবল কাগজে কলমে। কোনও কাগজপত্র যাচাই না করেই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামাণিক ও সাবেক জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হিমাংশু কুমার রায় সিংহ ব্যানবেইসের তথ্য প্রেরণের কাগজে স্বাক্ষর করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবে কোনও একাডেমিক কার্যক্রম না থাকলেও এবার ওই দুটি মাদ্রাসা থেকে ১৬ জন করে শিক্ষার্থীর নাম এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষার জন্য জমা দেওয়া হয়েছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার প্রত্যয়ন পেয়ে উপজেলা শিক্ষা অফিস ওই দুই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের ডিআর জমা নিয়েছে।

কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য নুরে আলম জানান, আমরা জানি না কীভাবে কোথা থেকে মাদ্রাসা দুটি হলো। ২০১৮ সালে খারুয়াগ্রামের ফজল ও ২০১৯ সালে বন্দেরপাড়ার মিজানুর মাদ্রাসা দুটি চালু করেছে।

কামাতকাজলদিঘী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোজাহার আলী জানান, এক দুবছর আগে মাদ্রাসা দুটির ঘর তোলা হয়। এর আগে কখনও এর অস্তিত্ব ছিল না। সরকারিভাবে ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা সঠিক নয়।

নতুন প্রতিষ্ঠিত ডুবানুচী বরকতিয়া স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম জানান, মাদ্রাসাটি অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত। তবে গত বছর থেকে এবতেদায়ী সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ১৯৬৫ সালের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা কেন ২০১৯ সালে প্রথম এবতেদায়ীতে অংশ নিলো- এই প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারেননি তিনি।

ওই মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ফজল হক জানান, ২০১৮ সালে মাদ্রাসা করার জন্য জমি দেন তিনি। মাদ্রাসার নাম জানা নেই তার। তার এক ছেলেকে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাদ্রাসায় চাকরি দেওয়া হয়েছে। আরেক ছেলে অন্য মাদ্রাসাটির প্রধান শিক্ষক। তিনি আরও জানান, জয়নুল নামে এক ব্যক্তি মাদ্রাসা দুটি স্থাপনে সহযোগিতা করছেন। জয়নুল দুটি মাদ্রাসারই কাগজপত্র তৈরি থেকে শুরু করে সব অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগসহ দৌড়-ঝাঁপ সবকিছু করছেন।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মোসলেম উদ্দিন জানান, এসব বিষয় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস দেখে। আমরা শুধু উপবৃত্তি ও পরীক্ষার বিষয়টি দেখি। আমাদের কাজের চাপ থাকায় স্বতন্ত্র মাদ্রাসাগুলো ভালো করে পরিদর্শনের সুযোগ হয় না।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম প্রামাণিক জানান, আমরা ওই মাদ্রাসাগুলোর কাগজপত্র চেয়েছিলাম। একটি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে, আরেকটি এখনও দেয়নি। কাগজপত্র পেলেই তা যাচাই করে দেখা হবে। তদন্তের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা যেন পরীক্ষা দিতে পারে তাই আমি প্রত্যয়ন দিয়েছি। তবে ব্যানবেইসে ভুল তথ্য প্রেরণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা শাহীন আকতার জানান, স্বতন্ত্র মাদ্রাসাগুলোর বিষয়ে মূল ভূমিকা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। তারা যে তথ্য দেন, আমরা শুধু সেগুলো পাঠিয়ে দেই।

পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ হোসেন জানান, আমি সদ্য যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেবো। কোনও অনিয়ম এবং জালিয়াতি প্রমাণিত হলে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আব্দুল মান্নান জানান, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে স্বতন্ত্র মাদ্রাসার যে তালিকা পাঠানো হয়েছে তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে পাঠানো হয়েছে। জালিয়াতি করার বিষয়টি আমাদের জানা নেই।

 

 

/এএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া