X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ে প্রকৃত শান্তির খোঁজে

মো. নজরুল ইসলাম (টিটু), বান্দরবান
০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:০০

এই চমৎকার স্নিগ্ধ পাহাড়ি পথটা যতই রোমাঞ্চকর মনে হোক-এমন পথেই এখনও মাঝেমধ্যেই ওঁৎ পেতে থাকে বিপদ। আর এ কারণেই পাহাড়ি দলগুলোর মধ্যে এখনও আছে দ্বন্দ্ব।

‌পার্বত্য শা‌ন্তিচুক্তির পর কেটে গেছে ২৩টি বছর। প্রায় দুই যুগ আগের এই চুক্তির ফলে সেনাবাহিনী তথা সরকারের সঙ্গে পাহাড়ি সংগঠনগুলোর সশস্ত্র সংঘাতটা এড়ানো গেছে, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর যুদ্ধে নামা মানুষগুলো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছে-মোটা দাগে সাফল্য এটাই। তবে পাহাড়ি সংগঠনগুলো এখনও দাবি করে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি সরকার। তারা পৃথক পৃথক প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে শোনায় হতাশা, ক্ষোভ ও অভিমানের গল্প। অন্যদিকে, সশস্ত্র যুদ্ধ এড়াতে পারাকেই সবচেয়ে বড় স্বস্তি ধরে নিয়ে সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে এই দিনটিকে ঘিরে চলে শান্তিচুক্তির সাফল্য প্রচারে নানামুখী তৎপরতা।  তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারী স্থানীয়দের সারাবছরের যে বিশ্লেষণ তাতে পাহাড়ি-বাঙালিদের অভিন্ন মন্তব্য, পাহাড়ে প্রতিবছরই বাড়ছে চাঁদাবাজি; ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর দলগুলো চার খণ্ডে বিভক্ত হওয়ায় মোটেও কমেনি সংঘাত। সেই যুদ্ধটা এড়ানোর স্বস্তি আছে তবে প্রকৃত শান্তি এখনও ফেরেনি পাহাড়ে। 

সরাসরি সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের এই দিনে সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় ওরফে সন্তু লারমা এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। সন্তু লারমার দল এরপর গত দুই দশক ধরেই দাবি করে আসছে চুক্তির অনেকগুলো ধারা বাস্তবায়ন করেনি সরকার। তবে তাদের বিরুদ্ধে পাহাড়ি অন্য সংগঠনগুলোরই অভিযোগ, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পুরোপুরি অস্ত্র সমর্পণের কথা থাকলেও এখনও তার দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রবাজি এবং প্রতিপক্ষকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। অস্ত্রের পথ ছেড়ে প্রথাগত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে জেএসএস আসতে না পারার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল প্রতিপক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। কারণ, চুক্তির সময়েই পাহাড়ে বিবদমান প্রতিপক্ষ ছিল ইউপিডিএফ। এছাড়াও জেএসএস এর প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র লারমার অনুসারীরা মূল আদর্শে থাকতে চাওয়ায় দলটি বিভক্ত হওয়ায় পাহাড়ি প্রতিপক্ষের সংখ্যা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে আদর্শ কিংবা স্বার্থের সংঘাতে ইউপিডিএফও ভেঙে যাওয়ায় জুম্ম জাতির অধিকারের কথা এখন কেবলই আদর্শিক স্লোগান; নৃ-গোষ্ঠীর মানুষদেরই অভিযোগ রয়েছে, ঐক্য নয় পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তাক করে এমন আদর্শের কথা বলে সংগঠনগুলো।

চাঁদাবাজি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বলি হয়ে এভাবেই পাহাড়ের রাস্তায় মাঝে-মধ্যেই পড়ে থাকে লাশ। স্বজনদের এমন আর্তনাদ যেন শান্তিচুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পাহাড়ে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার জন্য তাহলে দায়ী কারা?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মারমা নৃগোষ্ঠীর একাধিক বাসিন্দা গত দুই যুগের রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন, পাহাড়ে আগে যুদ্ধ ছিল। ফলে তখনও শান্তি ছিল না। যুদ্ধ থামার পর পাহাড়ি সংগঠনগুলোর বিবাদ তো লেগেই আছে, এরমধ্যে বেড়ে গেছে বাঙালি বসতি। হু হু করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জমিজমাহীন বাঙালিরা এই পার্বত্য এলাকায় এসে অবাধে কেটে ফেলছে পাহাড়, গাছপালা, জঙ্গল। আস্ত পাহাড় কেটে মাটি সমতল করে বসতি গড়ার ঘটনা এখানে অনেক-আগে এই বিষয়টা ভাবতেই পারতেন না তারা। এ কারণে অনেক পাহাড়ি বাসিন্দা হারিয়েছেন জুম চাষের জমি। হারিয়েছেন বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চাষ করে আদি পদ্ধতিতে ফসরের চাষাবাদ। তবে এর বিপরীতে বাঙালিদের দেখাদেখি যন্ত্রনির্ভর চাষাবাদে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন তারাও। এটা উন্নতি-তাও অস্বীকার করার উপায় নাই। ফলে এখন পাহাড়ি বাঙালি মিলে মিশে থাকতে হচ্ছে।

তবে নিজেদের শান্তি এখনও আসেনি-এমন হতাশা জানিয়ে এই প্রবীণ মারমা সদস্যরা বলেন, আগের তুলনায় পাহাড়ে ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে চাঁদাবাজি। এই চুক্তির আগে তাদের চাঁদা দিতে হতো যুদ্ধের নামে, এরপর তারা মুক্তি পাবেন আশা করলেও সেই সময়টি কখনোই আসেনি। আগে মোটামুটি হারে একটা চাাঁদ নিয়ে যেত সশস্ত্র সংগঠনগুলো। তবে গত ২৩ বছরে এই সংগঠন চার টুকরা হওয়ায় সবাই তাদের কাছে আসে চাঁদা নিতে। গরু-ছাগল, মুরগি, ধান, কলা, জুমের ফসল কিছুই বাদ যায় না চাঁদার আওতা থেকে। ছেলেরা চাকরি করলেও চাঁদা দিতে হয়,ব্যবসা করলেও দিতে হয়। কেউ রশিদ দিয়ে চাঁদা নেয়। কেউ রশিদ ছাড়াই চোখ পাকিয়ে না হয় অস্ত্র দেখিয়ে। ভয়ে আমরা কিছুই বলতে পারি না। আগে শুধু আমাদের মানে পাহাড়িদের চাঁদা দিতে হতো। এখন হাট-বাজারসহ বাঙালিদেরও মাঠের ফসল, বাড়ির এটা-সেটার জন্য চাঁদা দিতে হয়। প্রায়ই চাঁদা আদায়কারীদের দ্বারা অপহরণ, মারধর, হত্যার শিকার হন অনেকেই। সব কথা কাগজে উঠে আসেও না। অনেকেই ভয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ করে না।    

সন্ত্রাসীদের হামলার সময়ে ব্যবহৃত গুলি ও কার্তুজ বক্স।

নাম প্রকাশ না করে এই এলাকার বেশ কিছু বাঙালি বলেছেন, পাহাড়ি গ্রামগুলোতে নিরাপত্তার বড়ই অভাব। নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য পুলিশ কিংবা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের রাতে সচরাচর পাওয়া যায় না। পাহাড়ি সংগঠনগুলো এখনও সশস্ত্র। বিশেষ করে রাতে তারা অস্ত্র ছাড়া এক পাও ফেলে না। যুদ্ধ থামলেও এখনও প্রতিপক্ষের অ্যামবুশের স্বীকার হওয়ার ভয় আছে সব পক্ষের। প্রতিদিনই কেউ না কেউ প্রতিপক্ষের টার্গেট হয়। রাতে তার খোঁজে চলে অভিযান। এ কারণে রা‌তে পাহাড়ি গ্রামগু‌লো প্রায়ই  পুরুষশূ‌ন্য থা‌কে। মা‌সের পর মাস, বছ‌রের পর বছর ধরে অনেক নেতা নিজ বা‌ড়িমুখো হন না। গত তিন বছর শুধু বান্দরবানেই সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়ে‌ছে ২৫ জন। এছাড়াও তিন পার্বত্য জেলায় একশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়ে‌ছে।

এমন পরিস্থিতিতে পাহাড়ে বাস করা বাঙালিদের বেশিরভাগ সময়ে প্রতিবাদের বদলে সমঝোতা করেই থাকতে হয়। চাঁদা দিতে হয় সশস্ত্র সংগঠনগুলোর নির্দেশ মাফিক। তবে এই চাঁদাবাজি স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকদের ওপরে আরও বেশি হয় বলে জানান তারা। পুরো দেশের সঙ্গে এখানেই ব্যতিক্রম তিন পার্বত্য জেলা; আইন শৃঙ্খলা এখানে মাঠ পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ ও শক্তি প্রয়োগ না করে শান্তি ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। 

ঘটনার পর পুলিশে এভাবেই দলবলসহ অভিযানে নামে।

জানতে চাইলে বান্দরবান জেলা যুগ্ম দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভো‌কেট মিজানুর রহমান ব‌লেন, একের পর এক মানুষ খুন-গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণের শিকার হলেও সন্ত্রাসীরা বরাবরই রয়ে‌ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। তি‌নি ব‌লেন, সম্প্র‌তি তা‌দের বিরু‌দ্ধে মামলাও বৃ‌দ্ধি পা‌চ্ছে। কিন্তু বে‌শিরভাগ ক্ষে‌ত্রেই আসামিরা র‌য়ে‌ছে ধরাছোঁয়ার বাই‌রে।

বান্দরবান জেলা বিএনপির  সাধারণ সম্পাদক মো. জাবেদ রেজা ব‌লেন, বিএনপি ও বাঙালি সংগঠনগুলোর দাবি হচ্ছে ১৯৯৭ সালে তড়িঘড়ি করে শা‌ন্তিচুক্তিটি সম্পাদনসহ চুক্তি বাস্তবায়নের কথা বলে গহীন অরণ্য থে‌কে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহার করে পুরো পার্বত্য এলাকাকে অনিরাপদ করে তুলেছে। আর এতে খুন-গুম, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা আরও বেড়ে গেছে। দলীয়ভাবে তা‌দের দা‌বি, এ চু‌ক্তি বা‌তিল ক‌রে পাহাড়ি- বাঙালি উভয় প‌ক্ষের প্র‌তি‌নি‌ধি রে‌খে নতুন ক‌রে চু‌ক্তি বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুবা একতরফা ভা‌বে চু‌ক্তি বাস্তবায়ন কর‌লে পাহা‌ড়ে কখ‌নোই প্রকৃত শা‌ন্তি ফি‌রে আস‌বেনা।

পার্বত্য জেলা প‌রিষদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লী‌গের যুগ্ম সম্পাদক লক্ষীপদ দাশ ব‌লেন, ১৯৯৭ সালে কোনও তৃতীয় পক্ষ বা দে‌শের সহযোগিতা ছাড়াই আওয়ামী লীগ এই চুক্তি সম্পাদন করেছিল। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামীলীগ সরকার প্রথম থে‌কেই খুবই আন্তরিক। চুক্তি বাস্তবায়নে উভয়পক্ষের এগিয়ে আসার দরকার। কিন্তু এতে জেএসএস এর কোনও ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। 

এই ঝুপড়ি ঘরের বাসিন্দারাও রেহাই পান না চাঁদার হাত থেকে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি  (জেএসএস) এর কেন্দ্রীয় ক‌মি‌টির সহ-সভাপ‌তি কেএসমং মারমা ব‌লেন, জেএসএস’র দাবিকৃত চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো এখনেও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং সরকার নানাভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে‌ছে। এতে পাহা‌ড়ের মানু‌ষের অধিকার ক্ষুণ্ন হ‌চ্ছে। চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সরকারকে তাগিদ দেন তিনি।

ত‌বে পাহাড়ে স্থায়ী শা‌ন্তি প্রতিষ্ঠায় পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অবিশ্বাস দূর করা জরুরি বলে মনে কর‌ছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
বাংলাদেশ ব্যাংকে সংবাদকর্মীদের প্রবেশে বাধা: উদ্বিগ্ন টিআইবি
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
আপাতত গরমেই খেলতে হচ্ছে সাবিনা-সানজিদাদের
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসেডর যুবরাজ
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন