X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরা গণভবনের সামনে সরকারি জায়গা দখলের মহোৎসব

কামাল মৃধা, নাটোর
১৫ জানুয়ারি ২০১৬, ১৭:০৬আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০১৬, ১৮:২০
image

দখল

বিখ্যাত দিঘাপাতিয়া রাজবাড়ি বা উত্তরা গণভবনের অবস্থান নাটোর জেলা শহর থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে। এককালে দিঘাপাতিয়া মহারাজাদের বাসস্থান এবং বর্তমান উত্তরা গণভবনটি প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবন হিসেবেও ব্যবহার হয়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাটির দিকেও এখন চোখ পড়েছে দখলদারদের। উত্তরা গণভবনের মোট ২ একর ৬৮ শতক জায়গার মধ্যে মাত্র ১৫ ফুট ছাড়া অবশিষ্ট সব জায়গায়ই চলছে দখলের মহোৎসব। দর্শনার্থীদের জন্য চারটি টয়লেট ছাড়া অবশিষ্ট কোনও জায়গাই সরকারের দখলে নেই।

গণভবনের সামনের পুরনো ভবন দখল করেছে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নামে একটি সংগঠন। সেখানে তারা গড়ে তুলেছে তাদের কার্যালয়। রয়েছে চায়ের দোকানও। অপরদিকে ফাঁকা জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়। এছাড়া বসেছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সরকারের এসব জায়গা প্রকাশ্যে দখল করে পাকা ভবন নির্মাণে জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন।

গণভবন

উত্তরা গণভবন ও জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়,দিঘাপতিয়ার রাজা দয়ারাম রায় ৪১ দশমিক ৫ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করেন এই রাজবাড়ি। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পর পাকিস্তান আমলে এটি গভর্নর হাউস করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভর্নর হাউসের নাম পরিবর্তন করে এর নাম দেন উত্তরা গণভবন। গণভবনের জায়গা ছাড়াও এর প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে ২ একর ৬৮ শতক জায়গা।

দেশ স্বাধীনের পর সরকার এই গণভবন ও এর সামনের জায়গা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এর দেখাশোনার জন্য গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়। গণভবনের সুদৃশ্য কারুকার্য খচিত প্রধান ফটক,রাজ প্যালেস,ইটালিয়ান গার্ডেনসহ ভেতরের সৌন্দর্য দেখার জন্য দেশ ও বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা আসলে তাদের ডিসি অফিসের মাধ্যমে পাশ নিতে হতো। কিন্তু তখন অনেক দর্শনার্থী পাশ না পেয়ে চলে যেতেন। বিষয়টি অনুভব করে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময় সরকার ১০ টাকার টিকেটের বিনিময়ে গণভবন দেখার অনুমতি দেন।

উত্তরা গণভবন

গণভবনের ভেতরের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে লাগানো হয় সিসিটিভি,চেকিং মেশিন। মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও আনসার বাহিনী। দর্শনার্থীদের জন্য প্রধান ফটকের সামনের ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ করা হয় চারটি টয়লেট। কিন্তু অন্যান্য জায়গা জুড়ে বসে যায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশের পর জেলা প্রশাসন ও পিডব্লিউডি’র উদ্যোগে উচ্ছেদ অভিযান চললেও কয়েকদিন পর আবারও তা দখল হয়ে যেত।

তাই দেড় বছর আগে জেলা প্রশাসন ও পিডব্লিউডির উদ্যোগে ফাঁকা জায়গাটির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর সিমেন্টের পোল ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে তা ঘিরে দেওয়া হয়। মাঝখানে বেশ কিছু অংশ জুড়ে লাগানো হয় বিভিন্ন গাছ। গণভবনের প্রধান ফটকের সামনে ফাঁকা জায়গায় ইট বিছিয়ে দেওয়া হয় যাতে দর্শনার্থীরা যানবাহন রাখতে পারেন। কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একটু একটু করে কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে আবার জায়গা দখল শুরু করেন। আর সেখানে স্থাপন করতে থাকেন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। একের পর এক গাছ কেটে ও ভেঙে ফেলা হয়।

সামনের জমি দখল

গণভবনের প্রধান ফটকের সামনে রয়েছে দুইটি পুরনো ভবন। দিঘাপাতিয়ার রাজার আমলে এর একটিতে ছিল চ্যারিটেবল ডিসপেনসারি। যাতে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতো। আর অন্য ভবনটি ছিল স্টাফ কোয়ার্টার। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া ভেঙ্গে চ্যারিটেবল ডিসপেনসারিতে করা হয়েছে চা-স্টল। আর স্টাফ কোয়ার্টারে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কার্যালয়। সর্বশেষ গত প্রায় ছয় মাস আগে ফাঁকা জায়গার প্রায় ১ বিঘা দখল করে নির্মাণ শুরু হয় দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের।

সরেজমিন দেখা যায়, ৪টি দরজা ও ৬টি জানালা,একটি করিডোর ছাড়াও গ্রিল ঘেরা ৩টি রুম নিয়ে ৩ নং দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় তৈরি করা করা হয়েছে। এখনও মেঝে পাকা করার কাজ চলছে। ভবনটির ভেতরে রয়েছে লম্বা তিনটি কক্ষ। যার উপরে টিনশেড। জানালা ও গ্রিলগুলোর রং সম্পন্ন হলেও চলছে মেঝে পাকাকরণসহ অন্যান্য কাজ। ভবনটির সামনে প্রায় দেড়শ ফুট জায়গা পাকা করা হয়েছে। পাকাস্থানে রয়েছে একটি কদম ও একটি বটগাছ। গাছটির বেদি পাকা করে বসার জায়গা করা হয়েছে। ভবনটির সঙ্গে রয়েছে দুইটি অ্যাটাচ টয়লেট।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুস সালাম সরকার জানান,বর্তমান আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ঠিক পেছনে দিঘাপতিয়া প্রসন্ন কালী ও কৃষ্ণজিউ মন্দিরের কালিপুকুরের জায়গা দখল করে ২০০৫ সালে তৎকালীন ভূমি উপমন্ত্রী,জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর নির্দেশে স্থানীয় বিএনপি নেতা আবুল হোসেন গেদু নির্মাণ করেন শহীদ জিয়া স্মৃতি সংসদ নামে ইউনিয়ন বিএনপি অফিস। কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনও অফিস ছিল না। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ওমর শরিফ চৌহান এগিয়ে আসেন। তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

গণভবনের সামনে

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান,নাটোর সদর আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল গত ১৬ ডিসেম্বর ভবনটি পরিদর্শন করেছেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে ভবনটির উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করছে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ।

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি,ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের নির্বাচিত সদস্য (মেম্বার) মকবুল হোসেন মন্টু দাবি করেন,দিঘাপতিয়া বাজার ঘিরে দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন হলেও ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় স্থানীয় বাজার থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে। ইউনিয়নের দলীয় নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষদের বিভিন্ন সালিসি বৈঠকের অধিকাংশ দিঘাপতিয়া বাজারে অনুষ্ঠিত হলেও লোকজনদের বসার তেমন কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয়টি নির্মিত হওয়ায় সেই সমস্যা দূর হতে চলেছে।

নির্মিত ভবনের স্থানসহ আশেপাশের স্থানগুলো আগে বিভিন্ন নোংরা আবর্জনায় গন্ধময় থাকত উল্লেখ করে তিনি দাবি করেন,ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ কার্যালয় হওয়ায় এখন পরিবেশ অনেক সুন্দর হয়েছে। দর্শনার্থীরা এখন আর আগের মত টয়লেটে এসে নাক সিঁটকে চলে যায় না। তারা কার্যালয়ের সামনের পাকা বেদীতে বসে বিশ্রাম নেয়।

জমি দখল

খন্দকার ওমর শরিফ চৌহান জানান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষদের কথা বিবেচনা করে তিনি ভবনটি নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন।

যদিও জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান জানান,আওয়ামী লীগের কার্যালয় নির্মাণের বিষয়টি তার জানা নেই। তবে এমন ভবন হয়ে থাকলে দ্রুত তা উচ্ছেদের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তৌফিক আল মাহমুদ জানান, এর আগেও কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। স্থায়ী কোনও বাউন্ডারি না করার ফলেই মূলত বার বার বিভিন্ন স্থাপনা ও এমন ভবন নির্মাণের ঘটনা ঘটছে। তবে গণভবনসহ সব জায়গা দেখাশোনা ও নির্মাণ বিষয়ে গণপূর্ত বিভাগ দায়িত্ব পালন করছে। তাই এ বিষয়ে প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে নাটোর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহম্মদ মশিউর রহমান আকন্দ জানান,ভবন রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক আর তিনি পদাধিকার বলে একজন সদস্য। তবে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের। ভবন নির্মাণের কথা জানার পর গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাবৃন্দ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাজ বন্ধ করার কথা বললেও তারা তাতে কর্ণপাত করেন নাই। যে কোনও উচ্ছেদ কার্যক্রম একটি সমন্বিত উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি জানান, দ্রুতই গণভবনের সামনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান,সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে প্রায় একমাস আগে গণভবনের সামনের জায়গা জুড়ে বাউন্ডারি করা বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তহবিল পেলেই বাউন্ডারি নির্মাণ করে স্থায়ীভাবে জায়গাটিকে দখলমুক্ত করে সেখানে গণভবনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ বা ব্যবহার উপযোগী করা হবে বলেও দাবি করেন তিনি।

/এসএম/এফএস/

আপ-এসটি

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
দুবাইতে বিশ্বের ২৩ নম্বর চীনের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
জিরোনার মাঠে বার্সেলোনার নাটকীয় হারে চ্যাম্পিয়ন রিয়াল
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
‘ফাইভ স্টার’ ম্যানসিটি, চার গোল হাল্যান্ডের
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
ঢাকায় পুনর্মিলন সেরে ক্যাঙ্গারুর দেশে...
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
লিথুয়ানিয়ার ড্রোন হামলা ব্যর্থ হয়েছে: বেলারুশ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ
এডিবি কর্মকর্তা গোবিন্দ বরের বিরুদ্ধে বিশিষ্টজনদের হয়রানির অভিযোগ