X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

আনোয়ার হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
১৬ মে ২০১৮, ১৪:১৮আপডেট : ১৬ মে ২০১৮, ১৭:৫৫

ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরাঞ্চলের মানুষ। শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এই অঞ্চল অনেকটা মরুভূমিতে পরিণত হয়। আবার বর্ষায় ফারাক্কার সব গেট খুলে দিলে হঠাৎ ফুঁসে উঠে পদ্মা। ভাসিয়ে নিয়ে যায় বাড়িঘর, ফসলসহ সবকিছু। তারওপর অব্যাহত ভাঙনে বসতভিটা, ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছে এ জেলার মানচিত্র। এমন পরিস্থিতে এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও নদী তীরবর্তী মানুষদের রক্ষার্থে নদী খননের কথা বলছেন পরিবেশবিদরা। আর ভারতের একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার ও ছেড়ে দেওয়ার ইস্যু আর্ন্তজাতিক ফোরামে তোলার পরার্মশ বিশ্লেষকদের।  

ভারত থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পদ্মা। ১৯৭৫ সালে এই পাংখা পয়েন্ট থেকে ২০ কিলোমিটার উজানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করে ভারত।  এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে এই নদীর গতিপথ। এক সময় সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই নদী ক্রমেই ভাঙতে থাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি, চরবাগডাঙ্গা, নারায়ণপুর, পাঁকা, উজিরপুর ও দেবিনগর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আর ভাঙন কবলিত এসব এলাকা পরিণত হয় ধু ধু বালুচরে। নিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের কারণে একাধিক চ্যানেলে বিভক্ত হয়ে পড়ে পদ্মা। যা এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের বড় কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

পাংখা পয়েন্ট থেকে শুরু করে রাজশাহীর গোদাগাড়ি পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪১ কিলোমিটার। আর পদ্মাপাড়ের ক্ষতিগ্রস্থ এসব এলাকায় ৮টি ইউনিয়নের প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে।

সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা এলাকার নৈমুদ্দিন ও আবদুল্লাহ জানান, ‘ফারাক্কা নামে মরণ ফাঁদের কারণে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার কোনও নমুনা পাওয়া যায় না। শুধু আষাঢ় মাস থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত ৫ মাস পানি থাকে। বাকি সময় চারিদিকে শুধু ধু-ধু বালুচর। বছরের পর বছর ধরে আমরা প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি ফারাক্কা বাঁধের কারণে। জায়গা-জমি, বাড়িঘর সবকিছু হারাচ্ছি আমরা নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষেরা।’ ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

এদিকে, এই অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য ও নদী তীরবর্তী মানুষদের রক্ষার্থে পদ্মা নদী খননের কথা বলছেন পরিবেশবিদরা। স্থানীয় পরিবেশ সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচারের’ সমন্বয়কারী রবিউল হাসান ডলার বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের গেট খুলে দেওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে বন্যা ও নদী ভাঙন। এর ফলে প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পদ্মা পাড়ের মানুষ এবং ফসলি জমি। শুষ্ক মৌসুমে পানি শূন্যতা এবং অসময়ে বেশি পানি প্রবাহের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পদ্মা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ ভারত নিয়ন্ত্রণ করার কারণে পদ্মার নাব্যতা হারিয়ে জেগে উঠছে বিশাল বিশাল চর।’

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা পৃথিবীর বৃহৎ চারটি নদীর অন্যতম। একটি নদী শুধু পানিই সরবরাহ করে না, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। পদ্মা নব্যতা হারানোয় দেশি জাতের মাছ, শুশুক, ঘড়িয়ালসহ নানা মেরুদণ্ডি ও অমেরুদণ্ডি প্রাণি এবং জলজ উদ্ভিদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শুশুক ও ঘড়িয়াল এখন বিলুপ্ত প্রায়। এভাবে চলতে থাকলে এ নদী নিকট ভবিষ্যতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।  মানুষের জীবন জীবিকা এবং পরিবেশের ওপর এখন বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আরও ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।’ ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সর্ম্পকের অনেক উন্নতি হলেও পানির নায্য হিস্যার তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। তাই একতরফাভাবে তাদের এ নদীর পানি প্রত্যাহারের বিষয়টি আর্ন্তজাতিক ফোরামে তোলার পরার্মশ বিশ্লেষকদের। ফারাক্কা ইস্যুতে আন্দোলকারী ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম রেজা বলেন, ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা সমাধান করতে না পারলেও সারা পৃথিবীতে আমরা সাড়া জাগাতে পেরেছি। তাই ভালো পরামর্শের জন্য আর্ন্তজাতিক ফোরামে, বিশেষ করে জাতিসংঘের মতো ফোরামে পানির নায্যতা প্রাপ্তিতে এখনই কথা বলতে হবে সরকারকে।’

তিনি বলেন, ‘সর্বজনবিদিত অমীমাংসিত ও অকার্যকর এই বিষয়টি যেহেতু এখনও জীবিত আছে তাই এখনই জাতীয়ভাবে পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে।’ তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, ‘আমরা নাগরিক হিসেবে যা ভাবি, আমাদের সর্মথনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সমস্যাগুলো নিয়ে সেভাবে ভাবেন না। নবম সংসদ অধিবেশনের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসলেও এখানকার জলন্ত একটি সমস্যা নিয়ে স্থানীয় এমপিরা সংসদে কোনও কথাই বলেননি। এটা বেদনার, এটা বিষাদের, এটা দুঃখের।’ ফারাক্কার কারণে চরাঞ্চলে বিপন্ন জীববৈচিত্র্য

ফারাক্কার কারণে জেলার অন্যান্য নদীগুলোতেও (মহানন্দা, পাগলা ও পূর্নভবা)  ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। পদ্মা নদীকে নির্দিষ্ট চ্যানেলে ধরে রাখা যাচ্ছে না বলে জানান চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর প্রধান নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা নদী সবচেয়ে বেশি পলি বহন করে, যা পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়। আর এতে পানির প্রবাহ বাধা পড়ায় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ফারাক্কা ব্যারেজের বাংলাদেশ অংশে পলি পড়ে পুরোটাই চর পড়ে গেছে। ফলে পানির গতি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় স্থানভেদে চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা নদীর প্রস্থ ৪ থেকে সাড়ে ৪ কিলোমিটার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ আগে এর প্রস্থ ছিল দেড় থেকে ২ কিলোমিটার। তাই এখনই যদি আমরা পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে দুই পাড়ের ভাঙনের কারণে পদ্মা নদীর প্রস্থ আরও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। ভাঙনও বাড়বে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী সৈয়দ সাহিদুল আলম জানান, ‘পদ্মা নদীর নাব্যতা দিন দিন  কমে যাওয়ায় গত ১০ বছরে পানির লেয়ার স্থানভেদে ২০ থেকে ৩০ ফুট নিচে নেমে গেছে। বছরে যা গড়ে ২ ফুটেরও বেশি করে নিচে নেমে যাচ্ছে। পানির লেয়ার নিচে নেমে যাওয়ার এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এই অঞ্চল সম্পূর্ণরূপে মরুভুমিতে পরিণত হবে। বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক। এমন পরিস্থিতিতে সরকার নদী ড্রেজিং করে মাছের উৎপাদন, সেচ-সুবিধাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারে সচেষ্ট হবে। সর্বোপরি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে পানিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়নে সরকারকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।’

 

/এফএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিএনপি নেতা ফালুর বিরুদ্ধে আরও একজনের সাক্ষ্য
বিএনপি নেতা ফালুর বিরুদ্ধে আরও একজনের সাক্ষ্য
খুলনায় ঢালাই স্পেশাল সিমেন্টের ডিলার পয়েন্ট উদ্বোধন
খুলনায় ঢালাই স্পেশাল সিমেন্টের ডিলার পয়েন্ট উদ্বোধন
কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাবস্টেশনে আগুন
কাপ্তাইয়ে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাবস্টেশনে আগুন
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হামাস যোদ্ধাসহ ৫ ফিলিস্তিনি নিহত
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হামাস যোদ্ধাসহ ৫ ফিলিস্তিনি নিহত
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি