২০০৪ সালের জুন মাসে নগরীর উপকণ্ঠে ৭ দশমিক ৪১ একর জায়গার ওপর সাড়ে সাত কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল। ২০১১ সালের জুন মাসে পরিবহন মালিকদের কাছে টার্মিনালটি হস্তান্তর করে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ)। উদ্দেশ্য ছিল, নগরীর মূল কেন্দ্রে অবস্থিত শিরোইল বাস টার্মিনাল সরিয়ে শহরের বাইরে স্থাপন করা। যাতে করে শহরের যানজট ও দুর্ঘটনা কমে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পরও সেই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। এখনও শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকেই বাস চলাচল করছে। শুধু শিরোইল বাস টার্মিনালই না, যাত্রী ওঠানোর টার্মিনাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নগরীর মূল পয়েন্ট রেলগেট ও ভদ্রা মোড়। ফলে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা, তৈরি হচ্ছে যানজট।
গত ১৫ আগস্টও রেলগেটে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে নওদাপাড়া বাস টার্মিনালে বাস নিয়ে যাওয়ার পথেই নওদাপাড়া বাজারে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাস সড়ক থেকে দোকানে ঢুকে যায়। এতে নিহত হয় এক স্কুল ছাত্রীসহ তিনজন। আহত হন পাঁচজন।
পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও ট্রাফিক পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নওদাপাড়া আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচল করে। শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকার কোচ ও আন্তঃজেলা উপজেলা বাস চলাচল করে। আগে শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচল করতো। কিন্তু যানজট ও দুর্ঘটনা কমানোর লক্ষ্যে শহর থেকে সরিয়ে বাস টার্মিনাল নওদাপাড়ায় স্থানান্তরিত করা হয়। কিন্তু তারপরও আন্তঃজেলা ও ঢাকার কোচগুলো শিরোইল বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়। আর আন্তঃজেলার বাসগুলো নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল থেকে ছাড়া হলেও যাত্রী ওঠানো হয় ভদ্রা মোড় ও রেলগেট এলাকায়। ভদ্রা মোড়ে যাত্রী উঠিয়ে সেই বাস আবার তালাইমারীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠায়। তারপর নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট রুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিনোদপুর দিয়ে দেশের রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও পাবনার দিকে বাস যায়। আর রেলগেট থেকে যাত্রী উঠিয়ে নগর ভবন, বর্ণালী, বন্ধগেট, বহরমপুর, ডিঙ্গাডোবাসহ নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিয়ে চলাচল করে। শহরের এইসব জনবহুল ও ব্যস্ততম সড়কে, যেখানে নানা ধরনের ছোট ছোট যানবাহন চলে, সেই সড়ক দিয়ে ভারী যানবাহন চলাচল করায় ছোট-বড় দুর্ঘটনা লেগেই থাকে। এর আগেও নগরীর বহরমপুরে রেলগেটে একটি যাত্রীবাহী বাস সড়ক থেকে ছিটকে বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে। সেই বাসচাপায় ঘুমন্ত স্বামী-স্ত্রীসহ দুইজন নিহত হয়েছিলেন।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, শহরকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে চাইলে শহরের ভেতর থেকে বাস চলাচল বন্ধ করে বাইপাস দিয়ে চলাচল করাই ঠিক হবে। এতে শহর নিরাপদ ও সুন্দর থাকে। আর নওদাপাড়া বাস টার্মিনালতো খুব দূরেও না। বাইপাস দিয়ে সড়কও হয়েছে চমৎকার। বিভিন্ন আন্তঃজেলা ও ঢাকার বাসগুলো শহরে ঢোকার কোনও মানেই হয় না। আরও চওড়া সড়কও নির্মাণ করা হচ্ছে। ফলে শহরের বাইরে দিয়ে চলাচল করা সহজ ও সুন্দর হবে। সবচেয়ে বড় কথা, নগর ভবনের সামনে দিয়ে ব্যবহৃত গ্রেটার রোডকে আর হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার করা উচিতও না।
তবে পরিবহন মালিকরা বলছেন, শহরের বাইরে নওদাপাড়া বাস টার্মিনাল হওয়ায় সেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি থেকেই যায়। নিরাপত্তা ঠিকমত না থাকায় যাত্রীদের কথা বিবেচনা করেই ভদ্রা ও রেলগেট মোড় থেকে যাত্রী ওঠানো হয়। এছাড়া নওদাপাড়ায় বাস টার্মিনালে যেতে যাত্রীদের অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ করতে হয়। নগরীর ভদ্রা কিংবা রেলগেট থেকে বাসে উঠলে সেই টাকা খরচ হওয়া থেকে রেহাই পায় যাত্রীরা।
নগরীর ভদ্রা এলাকার বাসিন্দা জিয়া বলেন, এই এলাকায় তিনটি আবাসিক এলাকা আছে। এর বাইরে রয়েছে স্কুল ও কলেজ। অথচ ভদ্রা মোড়েই বসানো হয়েছে বাসস্ট্যান্ড। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এখানে যানজট লেগেই থাকে। কয়েক বছর আগে বাসস্ট্যান্ডের কারণে একজন রিকশাআরোহী বাসের চাপায় পৃষ্ট হয়ে মারা গেছেন। শুধু তাই না, সেখানে বাস টার্মিনালের কারণে প্রায় ছোট বড় দুর্ঘটনা ঘটছেই।
বর্তমানে নগরীর নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের প্রবেশ দ্বারগুলো বৃষ্টির পানিতে ডুবে রয়েছে। আশপাশে জঙ্গল গজিয়েছে। ভেতরে বাসে ভর্তি। এর মাঝে নতুন করে কিছু বাস প্রবেশ করছে আবার কিছু বাইরে বের হচ্ছে। তবে কোনও বাসেই যাত্রী নেই।
বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি বাসের চালকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, এখানে তারা বাসগুলো রেখে বিশ্রাম নেন। আবার শিডিউল টাইমে টার্মিনাল ছেড়ে মূল শহরের চিহ্নিত পয়েন্টগুলোতে গিয়ে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
এই বাস টার্মিনাল হওয়ার পরেও এখানে কেন যাত্রী তোলা হয় না এমন প্রশ্নে তারা বলেন, টার্মিনালটি শহর থেকে দূরে হওয়ায় যাত্রীরা এখানে আসতে চায় না। তাই এই টার্মিনালটি এখন বাস-ট্রাকের গ্যারেজ ও বছরে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের মেলা বসানোর জন্য ব্যবহার করা হয়।
রাজশাহী নগরীতে প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা। এই মানুষগুলোর চলাচলের সুবিধার্থে নগরীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এই মুহূর্তে নগরীতে শুধুমাত্র ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার সংখ্যাই রয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। প্রতিদিন নামছে আরও নতুন নতুন অটোরিকশা। এর বাইরে রয়েছে প্রায় ৮ হাজার সবুজ রঙের সিএনজি। যাববাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সে অনুপাতে নগরীর সড়কগুলো প্রশস্ত হয়নি। শুধু যাত্রী ওঠানোর কাজই না, বাসগুলো পরিষ্কার করার কাজে যেখানে সেখানে পার্কিংও করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মুনজুর রহমান পিটার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘প্রশাসন ও পুলিশ যদি নওদাপাড়ায় এলাকায় যাত্রীদের নিরাপত্তা দিতে পারে, তাহলে আমাদের সেখান থেকে যাত্রী ওঠাতে কোনও আপত্তি নেই।’
রাজশাহী মহানগরীর মেট্রোপলিটন পুলিশ মুখপাত্র ও সিনিয়র সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) ইফতে খায়ের আলম বরেন, ‘গ্রেটার রোড অনেক আগে থেকেই হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তারপরও সিটি বাইপাস নির্মাণ করা হয়েছে। গ্রেটার রোড হাইওয়ে হিসেবে ব্যবহার হবে কি হবে না, তার সঙ্গে অনেক সংস্থা জড়িত। বিশেষ করে রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ও সিটি করপোরেশন মুখ্য ভূমিকা পালন করে।’
এসব বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুর হক বলেন, ‘নগরীতে যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে বাসগুলো পানি দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। এক জায়গা সবসময় ভেজা থাকার কারণে সড়কের বিটুমিন নষ্ট হয়ে পাথর উঠে যাচ্ছে। রাস্তায় খানাখন্দের পরিমাণ বাড়ছে। এর বাইরে নগরীতে যেসব গাড়ির গ্যারেজ রয়েছে, সেই গ্যারেজগুলোতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় বাস-ট্রাক মূল সড়কে রেখেই মেরামতের কাজ করা হচ্ছে। এতে করে সড়কে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এসব বিষয়ে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছি। যাতে করে নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে বাস না থামিয়ে টার্মিনাল ব্যবহার করে যাত্রীরা।’