X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

শতাধিক ব্যক্তিকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন দুই কর্মচারী

নাজমুল হুদা নাসিম, বগুড়া
১৪ জুলাই ২০২৪, ১৮:২২আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২৪, ১৮:২৩

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার ১৭ জনের মধ্যে বগুড়ার গাবতলীর উপজেলার রয়েছেন দুই জন। তারা হলেন- নিয়ামুল হাসান জেমস ও মামুনুর রশিদ। এই দুই জন প্রতিবন্ধীসহ বিভিন্ন কোটায় আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও শতাধিক ব্যক্তিকে চাকরি দিয়েছেন। বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা ও জমি লিখে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন।

তাদের এমন কাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ায় গাবতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর বিপ্লব গত বছরের ১২ জুন দুদক বগুড়া কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দুদক তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা চলছে। জনগণ বলছেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা এত অপরাধ করতে পারতো না।

এই বিষয়ে দুদক বগুড়া কার্যালয়ের উপ-সহকারী পরিচালক আসাদুজ্জামান আসাদ জানান, অভিযোগটি পাওয়ার পর তিন সদস্যের কমিটির কাছে উত্থাপন করা হয়েছিল। এরপর সেটি অনুসন্ধানের অনুমতি পেয়েছিল কি না তা জানা নেই।

উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জানান, অভিযোগটি দুদক প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছিল।

অভিযুক্ত দুই জন হলেন- বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নারুয়ামালা ইউনিয়নের উত্তর দোয়ারপাড়ার মৃত আবদুল গফুর মন্ডলের ছেলে, ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের টেকনিশিয়ান নিয়ামুল হাসান জেসম ও একই উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের বাইগুনি মন্ডলপাড়ার মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক মামুনুর রশিদ। আগে জেমস পিএসসিতে অফিস সহায়ক পদে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন।

বগুড়ার গাবতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর বিপ্লব দুদক বগুড়া কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তখন পিএসসির অব্যাহতিপ্রাপ্ত কর্মচারী নিয়ামুল হাসান জেমস বগুড়ার বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে শতাধিক ব্যক্তিকে ভুয়া প্রতিবন্ধী কার্ড তৈরি করে দেন। তাদের প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরির ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রের ক্ষতি ও প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের বঞ্চিত করেছেন। জেমস তার স্ত্রী মৌসুমীকে আসল ঠিকানা গোপন করে ঢাকা জেলা কোটায় কাস্টমসে চাকরিতে নিযুক্ত করেছেন।

গাবতলী দোয়ারপাড়া গ্রামের মৃত ইসমাইল হোসেনের ছেলে পলাশের জমি নিজ ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের নামে লিখে নিয়েছেন। জেমস গত ২০১৫ সালে মেঘনা ব্যাংক ও ডাচবাংলা ব্যাংক লিমিটেডে বিপুল পরিমাণ টাকা জমা করেছেন। যা তদন্ত করলে সত্যতা মিলবে। ভুয়া প্রতিবন্ধী কোটায় গাবতলীর গড়দহ গ্রামের সাইফুল ইসলামকে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে স্পেয়ার মেকানিক্স, গাবতলীর বাইগুনি গ্রামের জয় কবির রিকোকে দুপচাঁচিয়ায় একই পদে, উনচুরকি গ্রামের ওয়াশিম কালুকে কাহালু উপজেলায় একই পদে, বাইগুনি গ্রামের জাহিদ হাসানকে রাজশাহীর বাগমারা এলজিইডি অফিসে ইলেকট্রিশিয়ান, একই গ্রামের মামুনুর রশিদকে পাসপোর্ট অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক পদে, বাইগুনি গ্রামের গোলজার রহমানকে রংপুরে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক, শামীম আহম্মেদ ফিরোজকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অফিস সহায়ক এবং গাবতলীর দোয়ারপাড়ার খায়রুল ইসলামকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অফিস সহায়ক পদে চাকরির ব্যবস্থা করেন।

জেমস তার স্ত্রী ছাড়াও বোন জেলি খাতুনকে বগুড়া গণপূর্ত বিভাগে, শ্যালক আবু সাঈদ ও একই এলাকার খায়রুল ইসলামকে স্বাস্থ্য বিভাগে, হযরত আলীকে বীজ প্রত্যয়ন অফিসে, উনচুরখি গ্রামের সাইফুল ইসলামকে হিসাব রক্ষণ অফিসে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।

গাবতলীর নারুয়ামালা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোজাম প্রামানিক জানান, নিয়ামুল হাসান জেমস তার স্ত্রী, বোন, আত্মীয় ও বিভিন্ন গ্রামের অন্তত ৫৫ জনকে টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন।

তিনি বলেন, সরকারি তদারকি না থাকায় জেমসের মতো কর্মচারী চাকরি দেয়। এসব চাকরির বিনিময়ে সে মোটা অঙ্কের টাকা ও সম্পদের মালিক হয়েছেন।

উত্তর দোয়ারপাড়ার বাড়িতে গেলে বগুড়া গণপূর্ত বিভাগের কর্মরত বোন জেলি খাতুন তার ভাই জেমস সম্পর্ক কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন।

চাচা আবদুল কুদ্দুস মন্ডল জানান, এলাকায় জেমসের অনেক সম্পত্তি আছে। তাই তাদের অবৈধভাবে চাকরি প্রদান ও টাকা-জমি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে জেমস এলাকার খায়রুল ও হযরতকে চাকরি দিয়েছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গ্রামবাসীরা জানান, পলাশ নামে একজনকে সরকারি পাইয়ে দিয়ে জেমস ও তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন জমি লিখে নিয়েছেন। জেমস এলাকায় অন্তত ১৩ বিঘা জমি কিনেছেন।

এদিকে জেমসের মাধ্যমে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে চাকরি পাওয়া মামুনুর রশিদও নিয়োগ বাণিজ্যে নাম লেখান।

গাবতলী উপজেলার দুর্গাহাটা ইউনিয়নের বাইগুনি মন্ডলপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামুনুর রশিদের মাধ্যমে অনেকই চাকরি পেয়েছেন। তার ভাই ও ভাবি ছাড়াও এলাকার আবদুল গফুরকে সমবায় বিভাগে, গোলজার রহমানকে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে, জাহিদ হাসানকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরে, সাইফুল ইসলামকে কৃষি অফিসে চাকরি দিয়েছেন।

মামুনুর রশিদের কলেজ পড়ুয়া বোন মিম জানান, তার ভাই পাসপোর্ট অফিসের চাকরি করেন। স্ত্রী ও এক সন্তানসহ ঢাকায় থাকেন। আরেক ভাই ফারুক হোসেন আদমদীঘির জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে, তার স্ত্রী রিমা সুলতানা গাবতলী উপজেলায় একই অফিসে কর্মরত। তার বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বগুড়া এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানিতে অফিস সহকারী পদে চাকরি করেন।

তবে মামুনুর রশিদ প্রশ্নফাঁস ও নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত এমন অভিযোগ আত্মীয়-স্বজনরা বিশ্বাস করেন না। তারা বলেন, এসব মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

তবে নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিবেশীরা জানান, নিয়ামুল হাসান জেসম ও মামুনুর রশিদ সম্পর্কে মামাতো ফুফাতো ভাই। জেমস মামুনুর রশিদকে পাসপোর্ট অফিসে চাকরি দিয়েছেন। পরে জেমস তাকে ড্রাইভার আবেদ আলীর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। এরপর মামুনুর রশিদ বাইগুনি ও বাওইটুনা গ্রামের কমপক্ষে ১৯ জনকে সরকারি বিভিন্ন কার্যালয়ে চাকরি দিয়েছেন। বিনিময়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন।

মামুনুর রশিদ নিজ এলাকায় কোনও সম্পদ না গড়লেও বাবা মোস্তাফিজুর রহমানের নামে বাইগুনি গ্রামে পাঁচ বিঘা জমি কিনেছেন। শ্বশুরবাড়ি দাড়াইল বাজার গ্রামে গরুর খামারসড় অনেক জমিজমা করেছেন। খামারে ২৫টি গরু থাকলেও সেখান থেকে অন্তত ১৫টি গরু অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।

গাবতলী উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল গফুর বিপ্লব জানান, তিনি এক বছর আগে নিয়ামুল হাসান জেসম ও মামুনুর রশিদের নিয়োগ বাণিজ্যের বিষয়ে দুদক বগুড়া কার্যালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বগুড়া জেলা প্রশাসক ও বগুড়া প্রেসক্লাবে দিয়েছেন। কিন্তু কেউ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা নিয়োগ বাণিজ্য ও প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িয়ে পড়েন। নামে-বেনামে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।

বিপ্লব বলেন, প্রভাবশালী বনে যাওয়া জেমসকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। তিনি তদন্ত করে এদের দুই জনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

/এফআর/
সম্পর্কিত
বিজিবির সাবেক ডিজিকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ
টিউলিপ সিদ্দিককে দুদকে তলব
স্ত্রীসহ সাবেক সংসদ সদস্য কিরণের বিরুদ্ধে দুদকের ২ মামলা
সর্বশেষ খবর
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ফেনীতে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ফেনীতে ‘ব্লকেড’ কর্মসূচি
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
এনসিপির কর্মসূচিতে আসেননি কোনও দলের শীর্ষ নেতা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
গাজায় ত্রাণ বিতরণের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
আ.লীগের বিচারের আগে কোনও নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না: চরমোনাই পীর
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান