সারা দেশে পাঁচ লাখ মেট্রিক টন সিদ্ধ চাল ও তিন লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে সরকার। ইতোমধ্যে ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। চলবে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত। এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেসব মিল সরকারের গুদামে চাল দেবে না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। একইসঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না তারা। তবে এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরও সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার চুক্তি করেনি দিনাজপুরের ৪১৮ চালকল। এসব মিলের লাইসেন্স বাতিলের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে জেলা খাদ্য বিভাগ।
যদিও মিল মালিকরা বলছেন, সরকার ধান ও চাল সংগ্রহের যে মূল্য নির্ধারণ করেছে তা বাজারের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে লোকসানের ভয়ে সরকারের গুদামে চাল দিতে চান না তারা। এ অবস্থায় মিলারদের ইনসেনটিভ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। গত ছয় মৌসুম ধরে সরকারের গুদামে চাল দিতে গিয়ে লোকসান গুনছেন বলেও দাবি মিল মালিকদের।
একই কথা বলছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, বাজারে ধানের যে দাম সেই অনুযায়ী সরকারি ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। পাশাপাশি বাড়তি জটিলতার কারণে সরকারি গুদামে ধান দেওয়ার জন্য আগ্রহী নন কৃষকরা।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, চলতি বছর প্রতি কেজি চালের মূল্য ৪২ টাকা এবং প্রতি কেজি ধানের মূল্য ২৮ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। এই দামে দিনাজপুর থেকে ৪৭ হাজার ৬৮৮ মেট্রিক টন চাল ও ১৪ হাজার ৪১৭ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করবে সরকার। ১৭ নভেম্বর থেকে ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে, চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
মৌসুম শুরুর পর থেকে মিলারদের চুক্তির আওতায় আনার জন্য কাজ শুরু করেছিল খাদ্য বিভাগ। এজন্য জেলার ১৯৬টি অটোরাইস মিল ও এক হাজার ৩৪৮টি হাসকিং মিল মালিককে চুক্তি করতে বলা হয়। কিন্তু বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও অধিকাংশ মিলার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেননি। গত ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তির সময় ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরও ১৩টি অটোরাইস মিল এবং ৪০৫টি হাসকিং মিল চুক্তিবদ্ধ হয়নি। ১৯৬টি অটোরাইস মিলের মধ্যে ১৮৩টি এবং এক হাজার ৩৪৮টি হাসকিং মিলের মধ্যে ৯৪৩টি চুক্তি করেছে। সময়সীমা শেষ হওয়ায় ইতোমধ্যে জেলা খাদ্য বিভাগ ৪১৮টি মিল সরকারের গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তি করেনি মর্মে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব মিলারের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত চুক্তিকৃত মিলগুলো সরকারের গুদামে ১৫ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন চাল দিয়েছে। পাশাপাশি কৃষকদের কাছ থেকে তিন মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে খাদ্য বিভাগ।
মিল মালিকরা জানিয়েছেন, বর্তমান বাজারে যে দামে ধান বিক্রি হচ্ছে তা থেকে চাল তৈরি করলে সর্বনিম্ন মূল্য দাঁড়ায় ৪৫-৪৬ টাকা। বর্তমান বাজারে সর্বনিম্ন ধানের কেজি পড়ে ২৯ দশমিক ৩৩ টাকা। এই দামে ধান কিনে চাল তৈরি করলে প্রতি কেজির মূল্য দাঁড়ায় ৪৫-৪৬ টাকা। কিন্তু সরকার নির্ধারণ করেছে ৪২ টাকা। ফলে কেজিতে তিন-চার টাকা লোকসান গুনে চাল দিতে আগ্রহী নন তারা।
জেলা সদরের গোপালগঞ্জ ধান বাজারে কথা হয় এক মিলারের সঙ্গে। নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমরা ধান কিনে চালকলে ভেঙে বাজারে বিক্রি করি। এটাই আমাদের ব্যবসা। এখন সরকার আমাদের কাছে চাল নিতে চায় খুবই ভালো কথা। কিন্তু লোকসান দিয়ে তো আর আমাদের সংসার চলবে না। সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উল্টো আমাদের চাপ দেওয়া হচ্ছে। কত লোকসান দেবো আমরা। আগে কিছুটা লাভ হতো, এখন চাল দিয়ে কোনও লাভ নেই।’
জেলা সদরের আরেক মিলার বলেন, ‘সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে তা বাজার এবং কৃষকের সঙ্গে সমন্বয় করে করা উচিত ছিল। এবার কৃষকদের উৎপাদন খরচ বিবেচনা না করেই দাম নির্ধারণ করেছে সরকার। তাই বাজারের দামের সঙ্গে সরকারের দামের মিল নেই। যদি দাম আরেকটু বেশি হতো; অন্তত ধানের বাজারের সঙ্গে মিল রেখে নির্ধারণ করলে আমাদের লোকসান গুনতে হতো না। গত কয়েক বছর ধরে আমরা চাল দিয়ে আসছি। কিন্তু এবার লোকসান দিয়ে চাল দেওয়া সম্ভব নয়।’
শুধু মিল মালিকরা নন, সরকার নির্ধারিত দামের সঙ্গে বাজারের দাম সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরাও। জেলার বাজারগুলোতে বর্তমানে যে দামে ধান বিক্রি হচ্ছে, তা সরকারি দামের চেয়েও বেশি। ফলে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চান না কৃষকরাও। সেইসঙ্গে ধান সংগ্রহের জন্য যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে সেসবে যেতে চান না কৃষকরা।
জেলার বাজারগুলোতে বর্তমানে ৭৫ কেজির বিআর একান্ন জাতের ধানের বস্তা ২২০০-২৩০০, গুটি স্বর্ণা ২২৫০-২৩০০, সুমন স্বর্ণা ২৩০০-২৩৫০, বিআর উনপঞ্চাশ ২৫০০-২৫৫০, শম্পা কাঠারি ৩১০০-৩২০০, বিআর নব্বই (জিরা) ৩৮০০-৩৯০০, স্থানীয় জিরা ৪২০০-৪৩০০, কাঠারি ৫৪০০-৫৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এক সপ্তাহ আগে এসব ধানের বস্তা ১০০ থেকে ৪০০ টাকা বেশিতে বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বাজারে সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে বিআর একান্ন জাতের ধান। প্রতি বস্তার দাম ২২০০-২৩০০ টাকা। অর্থাৎ সর্বনিম্ন প্রতি কেজির দাম পড়ে ২৯ টাকা ৩৩ পয়সা। যা সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে এক টাকা ৩৩ পয়সা বেশি।
জেলা সদরের গোপালগঞ্জ বাজারে ধান বিক্রি করতে আসা ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘বাজার আমাদের বাড়ির পাশেই। সকালে ধান নিয়ে এসে দুই ঘণ্টার মধ্যেই বিক্রি করে বাড়ি ফিরি। সরকারি গুদাম শহরে। সেখানে ভ্যানে ধান নিয়ে যাওয়া, মাপযোগ করা, ব্যাংক থেকে টাকা নেওয়াসহ নানা ধরনের ঝামেলায় পড়তে হয়। আমরা সাধারণ কৃষক এসবে অভ্যস্ত না। এরপরও যদি দাম বেশি হতো তাহলে সমস্যা ছিল না। এখন তো বাজারের দামের চেয়েও কম। কয়েক বছর আগে লাভ হতো। তাই সরকারি গুদামে ধান দিয়েছিলাম। এখন দিলে লোকসান গুনতে হবে।’
জেলা সদরের আরেক কৃষক রমেন চন্দ্র বলেন, ‘এবার উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। সেচ দিয়ে চারা রোপণ করতে হয়েছে। পোকার আক্রমণ ছিল, সার সংকটের ফলে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। ফলে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার খরচ বেশি পড়েছে। এসব বিবেচনা করে যদি সরকার মূল্য নির্ধারণ করতো তাহলে আমরা লাভবান হতাম।’
আরেক কৃষক সেলিম রেজা বলেন, ‘লাভের আশায় ধান চাষ করি। যেখানে দাম বেশি পাবো সেখানে ধান দেবো। সরকারি গুদামে আমরা ধান দিতে চাই। কিন্তু লাভ না হলে কীভাবে দেবো? তারপর নানা ঝামেলা তো আছেই। ধান বিক্রি করতে গিয়ে যদি ঝামেলায় পড়তে হয় তাহলে বাজারই আমার জন্য ভালো।’
সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে সেই দামে ধান পাওয়া যায় না উল্লেখ করে দিনাজপুর চালকল মালিক গ্রুপের সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘কম দামে আমরা ধান-চাল দেবো কীভাবে। এখন নতুন আইন করেছে সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ না করলে লাইসেন্স বাতিল করা হবে, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে এবং আমাদের ব্যবসা করতে দেবে না। আমরা এ বিষয়ে আপিল করেছি। আশা করছি, একটা সমাধান আসবে।’
আর কত বছর লোকসান দেবো দাবি করে মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ‘দাম কমের কারণে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না। তখন তো কৃষকের লাইসেন্স বাতিল করে না, কৃষককে তো বলে না তুমি আবাদে যেও না। তাহলে মিলারদের কেন বলে। মিলাররা তো নিজের টাকায় ব্যবসা করেন। সরকারকে ভর্তুকি কতদিন দেবো আমরা? এক-দুই-তিন বছর— কত বছর দেবো? গত কয়েক বছর ভর্তুকি দিচ্ছি। আর দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের চালের প্রয়োজন আছে, আমরা এই দামে চাল দিতে রাজি আছি। কিন্তু যেহেতু এই দামে ধান-চাল পাওয়া যাচ্ছে না তাই একটা ইনসেনটিভ চেয়েছি আমরা। তারও কোনও কিছু হলো না।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কামাল হোসেন বলেন, ‘জেলার ১৩টি অটোরাইস মিল এবং ৪০৫টি হাসকিং মিল সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়নি। সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী যারা চুক্তি করেনি তাদের লাইসেন্স বাতিল হবে। ইতোমধ্যে বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি আমরা। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে খাদ্য মন্ত্রণালয়।’
তবে শুধু এবারই নয়, গত বোরো মৌসুমে জেলায় শতভাগ ধান ও চাল সংগ্রহ হয়নি। ওই মৌসুমে জেলায় প্রায় ৯৭ শতাংশ চাল আর প্রায় ৯৩ শতাংশ ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছিল। যদিও এবার আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৩২ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সাত লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিক টন।