চারপাশে অথই পানি। ব্রহ্মপুত্র তার জলরাশি নিয়ে দ্রুতবেগে প্রবাহিত হচ্ছে। যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি। এরই মাঝে কয়েকটি বসতি উঁকি দিচ্ছে। কাছে যেতেই দেখা গেলো, বাড়ির আঙিনায় ও ঘরের ভেতর কোমরসমান পানি। ঘরের ভেতর বিছানা পর্যন্ত বাঁশ দিয়ে অনেকটা সাঁকোর মতো পথ তৈরি করা হয়েছে। টিউবওয়েল আর শৌচাগার পানিতে মাথা বের করে যেন শ্বাস নিচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো বাড়িটি দিনমজুর হযরত আলীর। গ্রামের নাম দক্ষিণ-পূর্ব বালাডোবার চর। কুড়িগ্রামের উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্রের দ্বীপচর এটি। রবিবার (১৬ জুলাই) দুপুরে এই গ্রামে গিয়ে জানা গেলো বানভাসিদের নানা কষ্টের কথা।
পানিতে প্লাবিত হযরত আলীর ঘরে থাকার পরিবেশ নেই। পাশেই কিছুটা উঁচু ছোট একটি ঢিপির ওপর চালাঘর। পলিথিন আর পাটখড়ির ছাউনি, বাঁশের বেড়া। এর ভেতরে থাকছেন তিন নারী ও তিন শিশু। ভেতরে যেতেই দেখা গেলো, দুটি গরু ও একটি বাছুর। এতে বোঝা গেলো, এটি গোয়ালঘর। ঘরের ভেতরে থাকা নারীদের একজন হযরত আলীর স্ত্রী লালবানু। শুকনো স্থানের অভাবে তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু ওই গোয়ালঘরে শিশুদের নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে গরুর সঙ্গে তাদের বসবাস ও খাওয়া-দাওয়া।
লালবানু জানান, তাদের কষ্টের সীমা নেই। দীর্ঘ একমাস ধরে পানিবন্দি। ঈদের আগে তাদের বাড়িতে পানি ওঠে। সেই পানি না নামতেই আবারও বন্যার কবলে পড়ে গ্রামের সবকটি পরিবার। রান্না, জ্বালানি ও খাবার পানির সংকটে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। শৌচাগার সংকটে নারী ও কিশোরীদের অবস্থা বেগতিক।
লালবানু বলেন, ‘থাকার কষ্ট, খাওয়ার কষ্ট। রান্দনের খড়ি নাই। পানিও আনন লাগে দূরের চর থাইকা। আইজ কয়দিন থাইকা বাচ্চাগো লইয়া গরুর ঘরে বসবাস করতাছি। এহানেই একবেলা রাইন্দা তিনবেলা খাই। এই কয়দিনে খালি একবার ১০ কেজি চাইল পাইছি (সরকারি সহয়তা)। তরিতরকারি আর পানির খুব কষ্ট।’
‘চাইর পাশে পানি। রাইতে শ্যালো নৌকার শব্দ শুনলে ডর লাগে। না জানি চোর আইসা বর্গা নেওয়া গরু দুইডা নিয়া যায়। আমগো কষ্টের শ্যাষ নাই’ সংকট ও আতঙ্কের কথা যোগ করেন লালবানু।
একই গ্রামের আরেক বানভাসি আমজাদ আলী (৬২)। সহায়তা হিসেবে সরকারি চাল পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চাইলের সঙ্গে ডাইল আর আলু দিলে আমগো কিছুটা উপকার হইলো হয়। আর এহানকার মাইষের ভিটা উঁচা করি দিলে এতো কষ্ট কইরা থাকন লাগতো না।’
বালাডোবা গ্রামের বসবাসরত ২৫ পরিবারের অবস্থা এমনই। বসতঘরে হাঁটু থেকে বুকসমান পানি। টিউবওয়েল, শৌচাগার সব পানির নিচে। কোনও কোনও পরিবার গবাদিপশুসহ এক চালার নিচে বসবাস করছে। সেই চালায় একসঙ্গে খাবারও খাচ্ছেন, রাত্রীযাপন করছেন। এমনকি বাড়িতে পোষা মুরগিগুলোও তাদের সঙ্গে ওই ছোট পরিসরে আবদ্ধ।
রবিবার দুপুরে বালাডোবা গ্রামে যাওয়ার আগে ওই ইউনিয়নের আরেক গ্রাম মুসার চরের বানভাসি রাবেয়া খাতুনের (৫০) সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। রাবেয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির আঙিনায় নৌকায় দাঁড়িয়ে কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন রাবেয়া। ঘরে তার অসুস্থ ও বৃদ্ধ স্বামী সুলতান।
নিজেদের দুর্গতির বর্ণনা দিয়ে রাবেয়া বলেন, ‘ঘরের ভেতরত, বাইরত পানি। রান্দনের জায়গা নাই। টুলের ওপরা চুলা থুইয়া পানিত দাড়ে রান্দি। ভাত খাওনের তরকারি নাই। কোনও বেলা লবণ দিয়া, কোনও বেলা কাটলের বিচি দিয়া ভাত খাওন লাগে। একবেলা রান্দি তিনবেলা খাই। খাওনের পানি আনা লাগে দূর থাইকা। আমরা খুব কষ্টে আছি।’
রাবেয়া জানান, এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। শুধু রান্না আর তরকারির কষ্ট নয়, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও শৌচাগার সংকট তাদের কষ্টের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজগার না থাকায় বাজার সদাই করার সামর্থ্য নেই তাদের।
মুসার চরের এই দম্পতির মতো একই চরের অন্যসব পরিবার তো বটেই, কুড়িগ্রামের শত শত বানভাসি পরিবারের অবস্থা এমনই। উঁচু স্থান কিংবা নৌকায় করে দিনাতিপাত করলেও বিশুদ্ধ পানি, তরকারি আর গবাদিপশুর খাবার সংকটে বিপাকে পরিবারগুলো। নদীর ঘোলা পানির সঙ্গে বসবাস করা পরিবারগুলোর শুকনো স্থান, জ্বালানি, পর্যাপ্ত খাবার আর বিশুদ্ধ পানির অভাবে মানবিক সংকটে দিনযাপন করছে।
মুসার চর ও বালাডোবার চরের বানভাসি পরিবারগুলোর অবস্থা জেনে ইউনিয়নের উত্তর বালাডোবা, ফকিরের চরসহ কয়েকটি চরের বানভাসিদের সঙ্গে কথা বলে একই কষ্টের চিত্র দেখা গেছে। খাবার পানি, রান্নার স্থান ও জ্বালানি সংকটে পরিবারগুলো চরম বিপাকে পড়েছে। এর সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ায় চরে আবাদ করা চিনা বাদাম, কাউন ও তিলসহ বিভিন্ন শস্য পানিতে তলিয়ে গেছে। সেগুলোর ফসল ঘরে তোলার আশা হারিয়েছেন চরবাসী।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্যমতে, চলমান বন্যায় জেলার ৯ উপজেলায় ৪৫ ইউনিয়নের ১৮৫ গ্রাম কমবেশি প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের ৬১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। রবিবার পর্যন্ত জেলায় বন্যাদুর্গত ও ভাঙনকবলিতসহ ২২ হাজার পরিবারকে সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, রবিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রসহ জেলার প্রধান নদ-নদীর পানি হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আগামী ২৪ ঘণ্টায় পানিপ্রবাহ আরও কমতে পারে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। সরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তা বিতরণ অব্যাহত আছে। পানি কমে যাওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা পরিবারগুলো বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছে। আশা করছি, দুই-তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
বানভাসিদের খাবার পানি ও তরিতরকারি সংকটের বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ জোরদার করার পাশাপাশি নগদ অর্থ দিয়ে বানভাসিদের জন্য ডাল ও আলু জাতীয় সবজি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’