X
শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলা: ২২ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

তুহিনুল হক তুহিন, সিলেট
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০১আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:০১

২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটে আওয়ামী লীগের জনসভা ডাকা হয়েছিল। সেই জনসভায় ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার। তার আগের রাতে জনসভাস্থল আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের পার্শ্ববর্তী এলাকা ফাজিলচিশতে এক বিএনপি নেতার বাসায় গ্রেনেড তৈরি করতে গিয়ে বিস্ফোরণে নিহত হয় দুই জঙ্গি। ওই গ্রেনেড তৈরি করা হচ্ছিল শেখ হাসিনার জনসভায় বিস্ফোরণের জন্য। ভাগ্য ভালো গ্রেনেডটি আগেই বিস্ফোরিত হয়েছিল। না হয় বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যদিকে বাঁক নিতো। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র ছিল সেটি। দেশের রাজনীতির গতিপথ থমকে দেওয়ার যে চক্রান্ত হয়েছিল সেদিন, ২২ বছরেও সে হত্যাচেষ্টার মামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি। 

এত বছর অতিবাহিত হলেও আলোচিত মামলাটির কার্যক্রমে গতি নেই। বর্তমানে মামলাটি সিলেটের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে আছে। আদালতে সর্বশেষ সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছিল গত বছরের ১৬ জুন। এরপর সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। তবে চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর মামলার শুনানির তারিখ ধার্য আছে। মামলার আসামি সাঈদ আহমদ, আবু ওবায়দা ও শাহজাহান কারাগারে রয়েছেন। যার বাসায় গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল, সে বিএনপি নেতা ডা. আরিফ আহমদ জামিনে আছেন।

এদিকে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর হরকাতুল জিহাদের সদস্য ও শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি মাসুদ আহমেদ শাকিল ওরফে সুমনকে (৪৫) রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের বিশেষায়িত অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট। গ্রেফতার শাকিল নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামির (হুজি) সদস্য। জামিনে গিয়ে এক যুগের বেশি সময় পলাতক ছিল।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, হত্যাচেষ্টা মামলাটি ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। ৪৭ জন সাক্ষী রয়েছেন। ইতিমধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। অন্যতম আসামি মুফতি হান্নানকে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই মামলায় উল্লেখযোগ্য সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল (কোতোয়ালি থানার সাবেক এসআই) ও অভিযোগপত্র দাখিলকারী সিআইডির পরিদর্শক সিলেট ক্যাম্পের সাবেক পুলিশ পরিদর্শক প্রণব কুমার রায়সহ চার জন। ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেন আব্দুল আউয়াল। এ ছাড়া সাক্ষ্য দিয়েছেন মিজানুর রহমান এবং ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. কামাল পারভেজসহ আরও তিন জন।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় দুটি মামলা করেন সিলেট কোতোয়ালি থানার তৎকালীন ওসি আবু আল খায়ের মাতুব্বর। বিস্ফোরণের ঘটনার মাস দুয়েক আগে আবু আল খায়ের মাতুব্বর ডা. আরিফের মালিকানাধীন নগরীর বন্দরবাজার এলাকার মানচুরিয়া কালার ল্যাবে অভিযান চালান। তখন তিনি ছিলেন সিলেট পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ওসি। তার কাছে খবর ছিল, সেখানে বিপুল বিস্ফোরক মজুত ও সন্দেহভাজন লোকজন ছিল। তিনি আবু ওবায়দা ও শাকিলকে ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের পর শাকিল স্বীকার করেন, কয়েক মাস আগ থেকে জঙ্গিরা সিলেটে অবস্থান করেছিল। সুরমা ভ্যালি হোটেলে শাকিলসহ অন্যরা একাধিকবার স্বনামে-বেনামে অবস্থান করেছিলেন।

হত্যাচেষ্টা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মফুর আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শেখ হাসিনা হত্যাচেষ্টা মামলাটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকাজ আরও আগে নিষ্পত্তি হতো যদি আসামিদের নির্ধারিত তারিখে আদালতে হাজির করা যেতো। সাক্ষীদের কারণে মামলাটির কার্যক্রম এখন গতিহীন।’

মামলার আসামিরা দেশের বিভিন্ন কারাগারে রয়েছে উল্লেখ করে মফুর আলী বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে দেশের অন্যান্য আদালতে একাধিক মামলা বিচারাধীন। এজন্য দায়িত্বশীলরা যথা সময়ে তাদের সিলেটের ট্রাইব্যুনালে হাজির করতে পারছেন না। পুরাতন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হলে এই মামলার কার্যক্রমে গতি আসবে।’

মামলার এজাহার থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের জনসভার দিন শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি (হুজি)। ওই বছর আদালতে স্বীকারোকিমূলক জবানবন্দি দেন ঘটনাস্থল থেকে আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া হুজির সদস্য মাসুদ আহমেদ শাকিল। ২০০৬ সালের ৫ অক্টোবর গ্রেফতারকৃত আবু সাঈদ সিলেট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার কথা স্বীকার করেন। জবানবন্দিতে সাঈদ বলেন, ২০০১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরের মধ্যে শেখ হাসিনা শাহজালাল মাজারে যাওয়ার কথা ছিল। পরে তারা খবর পান শেখ হাসিনা শাহপরাণের মাজারে যাবেন। দুই মাজারে ওঁৎপেতে থাকার পর তারা জানতে পারেন শেখ হাসিনা জনাসভাস্থলে সরাসরি যাবেন। এরপর জঙ্গিরা জনসভাস্থলের অদূরে ফাজিশচিশত এলাকায় ভাড়া করা মেসে ওঠেন। ওই মেসে রাত ৮টার দিকে গ্রেনেডগুলো নাড়াচাড়া করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। ২০০১ সালের ২ অক্টোবর সিলেটের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং একই বছরের ১১ অক্টোবর ঢাকায় যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলে একই রকম তথ্য দেন শাকিল। 

আদালতের জবানবন্দিতে শাকিলের ভাষ্য ছিল এরকম, ‘২০০০ সালে এহেতশাম নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে পরিচয় হয় ডা. আরিফ আহমদ রিফার সঙ্গে। তিনি জানিয়েছিলেন সিলেটে তার বন্ধু ডা. আরিফ আহমদ। আরিফ সিলেটে একটি হাসপাতাল ও সাভারে কোল্ড স্টোরেজ করতে চান। এ জন্য লোক দরকার। সেই পরিচয়ের সূত্রে ২০০১ সিলেটে আসি ও সুরমা ভ্যালি রেস্টহাউসে অবস্থান নিই। রুমটি ডা. আরিফের নামে বুকিং করা হয়েছিল।’

হত্যাচেষ্টা মামলায় সাঈদ ২০০৬ সালের ১৯ অক্টোবর সিলেটের ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঢাকায় বসে করা হত্যা পরিকল্পনার বর্ণনা দেন।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘মুফতি হান্নান আমাকে জানান, শেখ হাসিনা সিলেটে জনসভা করতে যাবেন। তাকে বোমা মেরে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। আলোচনায় মুফতি হান্নান, আবু মুসা, লোকমান, জাফর ও আমি ছিলাম। এই কাজের জন্য ছয় জনকে ঠিক করা হয়। আবু মুসা, লোকমান, জাফর, আমিসহ আরও দুই জন (নূর ইসলাম ও ওবায়দা)। শাকিলই আমাদের বলেন, ডাক্তার আরিফকে চেনেন, তার বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবেন। পরে সাত জন সিলেটে আসি। আবু মুসা ও লোকমান বোমা তৈরির সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে আসেন। রাতে সিলেটে পৌঁছাই। শাকিল আমাদের রিকশায় করে ডা. আরিফের বাড়িতে নিয়ে যান।’ 

মামলার তদন্তে ও গ্রেফতার জঙ্গিদের জবানবন্দিতে ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হিসেবে মুফতি হান্নান, আবু সাঈদ, শাকিল, আবু ওবায়দা, শাহজাহান, ডা. আরিফ, আকাশ, আবু মুসা, লোকমান, ফেঞ্চুগঞ্জের জাফর, আবুবকর, ডালিম, রাজু, অমিত, সবুজ, আলমগীর, এহ্তেশাম ও পুলিশ সদস্য নূর ইসলামের নাম উঠে আসে। 

/এএম/ 
সম্পর্কিত
যেভাবে খালাস পেয়ে যাচ্ছে দুর্ধর্ষ আসামিরা
যতক্ষণ দেশবাসী পাশে আছে, কাউকে পরোয়া করি না: শেখ হাসিনা
প্রকল্পে নিজের নাম ব্যবহারের অনুমোদন দেবেন না প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
চীন বিষয়ে বিশেষজ্ঞকে ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র
আগুন নেভাতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ৭
আগুন নেভাতে গিয়ে ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ৭
১৮ শর্তে আ.লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিলো ডিএমপি
১৮ শর্তে আ.লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিলো ডিএমপি
নিহত পাইলটের লাশ হস্তান্তর, থানায় মামলা
নিহত পাইলটের লাশ হস্তান্তর, থানায় মামলা
সর্বাধিক পঠিত
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের বানান ভুল লিখলো সওজ, চলছে সমালোচনা
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান
অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়লে পারমাণবিকনীতি পরিবর্তন করবে ইরান