X
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
২৭ বৈশাখ ১৪৩২
আলোচিত ধর্ষণ মামলার অগ্রগতি নেই চার বছরেও

কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ: আসামিদের সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন বাদী

তুহিনুল হক তুহিন, সিলেট
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০১আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:০১

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে তুলে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় করা মামলার বিচারকাজ এখনও শুরু হয়নি। এরই মধ্যে ঘটনার চার বছর পূর্ণ হয়েছে বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর)। আসামিরা ছাত্রলীগ নেতাকর্মী হওয়ায় মামলার কোনও অগ্রগতি হয়নি। বরং আওয়ামী লীগের নেতাদের চাপে মামলার বাদী অনেক আগেই আসামিপক্ষের সঙ্গে গোপনে আঁতাত করেন। একইসঙ্গে বাদী মামলায় গ্রেফতার আসামিদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে দেখা করে তাদের খোঁজখবর নেন বলে জানায় কারা সূত্র।

কারাগার ও আদালত সূত্র জানায়, বাদী প্রায় এক বছর আগ থেকে আসামিপক্ষের সঙ্গে আঁতাত করে ফেলায় মামলার কার্যক্রম থমকে যায়। বাদী তার নিযুক্ত আইনজীবীর সঙ্গে এক বছর ধরে যোগাযোগ করছেন না। এমনকি মামলার কোনও খোঁজও নেননি। এ অবস্থায় আগে থেকেই আসামিদের মুক্তির বিষয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সে পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কারারক্ষী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘মাসে কয়েকবার ওই ধর্ষণ মামলার বাদী কারাবন্দি আসামিদের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। সবার কাছে পরিচয় গোপন রেখে আসামিদের আত্মীয় পরিচয়ে দিয়ে দেখা করে যেতেন। আদালত ও আওয়ামী লীগের নেতাদের দেওয়া নির্দেশনার ব্যাপারে আসামিদের অবগত করতেন। পাশাপাশি মুক্তির ব্যাপারে আশ্বস্ত করতেন। আসামিরাও কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তারক্ষী ও হাজতিদের বলতেন খুব শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আসামিদের সঙ্গে আর দেখা করতে আসেননি বাদী।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাদীর আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই মামলার বাদী গত এক বছর ধরে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ করছেন না। এমনকি বাদী মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় আমরাও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। যতটুকু শুনেছি, তিনি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থাকাকালীন নেতাদের কথায় চলাফেরা করতেন। সেইসঙ্গে তাদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। কয়েকবার কারাগারে গিয়ে মামলায় গ্রেফতার কারাবন্দি আসামিদের সঙ্গে দেখাও করেছেন বলেও আমাদের কাছে তথ্য আছে।’

মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে দক্ষিণ সুরমার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসেন। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করেছিলেন তারা। এ সময় কয়েকজন যুবক তাদের ঘিরে ধরে। একপর্যায়ে তাদের জিম্মি করে গাড়িতে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যায়। ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে নববধূকে ধর্ষণ করে তারা। পরে জানা যায়, ধর্ষণে জড়িতরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। ঘটনার দিন রাতেই গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে মহানগর পুলিশের শাহপরান থানায় নয় জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এর মধ্যে ছয় জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

ঘটনার পরপরই আসামিরা পালিয়ে গেলেও তিন দিনের মধ্যে আট জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ ও র‌্যাব। গ্রেফতার আট জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের আট নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। 

অভিযুক্তরা হলেন- বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের ছেলে মিজবাউল ইসলাম রাজন (২৭)। অভিযোগপত্রে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, আইনুদ্দিন আইনুল ও মিসবাউল ইসলামকে দলবেঁধে ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত করা হয়। রবিউল ও মাহফুজুর রহমানকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। 

১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, গ্রেফতার আট জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিক্যালের ওসিসির মাধ্যমে ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। দুই মাস পর ডিএনএ রিপোর্ট আসে। এতে ধর্ষণে জড়িত ছয় জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। বাকি দুজন ধর্ষণে সহায়তা করেছেন বলে জানা যায়। আট আসামিই বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এরপর ২০২২ সালের ১১ মে সিলেটের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহিতুল হক চৌধুরীর আদালতে মামলাটির অভিযোগ গঠন করা হয়। তবে এরপর থেকে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি।

কলেজ সূত্র জানায়, সাইফুর, রনি ও মাহফুজুর ইংরেজি বিভাগের স্নাতক শ্রেণির অনিয়মিত শিক্ষার্থী। অর্জুন সাবেক শিক্ষার্থী। রবিউল বহিরাগত। ছয় জনই ছাত্রলীগের কর্মী ও টিলাগড়কেন্দ্রিক একটি পক্ষে সক্রিয়। তারা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক রণজিৎ সরকারের অনুসারী।

কেন সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি জানতে চাইলে বাদীপক্ষের আইনজীবী শহীদুজ্জামান চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন দলের নেতাকর্মী হওয়ায় এই মামলার বিচার হোক চায়নি। ফলে মামলার কোনও অগ্রগতি নেই। যেহেতু অগ্রগতি নেই, সেহেতু বলা যায় মামলার ভবিষ্যৎ শূন্য। নতুন সরকার যেহেতু ক্ষমতায় আছে, দেখা যাক এখন আলোচিত এই মামলার বিচার দ্রুত শেষ হয় কিনা।’ 

কেন আগের সরকার বিচার চায়নি বলে মনে হচ্ছে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাদীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে মামলা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় মামলাটির স্থানান্তর প্রক্রিয়া আটকে যায়। এর মধ্যে উচ্চ আদালতের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে সরকারের পক্ষে ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ হরিপদ পাল কর্তৃক লিভ টু আপিল করা হয় বলে মামলার বাদীকে নোটিশ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মামলাটির স্থানান্তর প্রক্রিয়া থেমে যায়। এমন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আগের সরকার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি কিংবা বিচার শেষ হোক চায়নি।’

মামলার বাদীর সঙ্গে মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে মোবাইল ফোনে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদকের। মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলাটি কীভাবে কোন অবস্থায় আছে, তা আমার জানা নেই। আমি দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি না।’ 

আসামিদের সঙ্গে আঁতাত ও কারাগারে দিয়ে তাদের দেখা করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সত্য নয়। কারা এমন তথ্য দিয়েছে, তা আমি জানি না।’

মামলার আইনজীবীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে বাদী বলেন, ‘আমার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে কী নেই, এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।’

/এএম/
সম্পর্কিত
রাজধানীতে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ৩৫৯২ মামলা
২৭ শিল্পীর বিরুদ্ধে হঠাৎ মামলা করছেন কারা?
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: বিএসএফের হাতে ৯ বাংলাদেশি আটক
সর্বশেষ খবর
এল ক্লাসিকো: এই বিষয়গুলো কি জানা আছে?
এল ক্লাসিকো: এই বিষয়গুলো কি জানা আছে?
ক্রীড়াঙ্গনে সার্চ কমিটির মেয়াদ আর বাড়ছে না
ক্রীড়াঙ্গনে সার্চ কমিটির মেয়াদ আর বাড়ছে না
‘এক ঘণ্টার মধ্যে আ.লীগ নিষিদ্ধ না হলে, মার্চ টু যমুনা’
‘এক ঘণ্টার মধ্যে আ.লীগ নিষিদ্ধ না হলে, মার্চ টু যমুনা’
দেশের ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে চায় না: মির্জা ফখরুল
দেশের ১৮ কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে চায় না: মির্জা ফখরুল
সর্বাধিক পঠিত
জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
জরুরি বৈঠক ডেকেছেন প্রধান উপদেষ্টা
লঞ্চঘাটে তরুণীদের প্রকাশ্যে মারধর, যুবক বললেন ‘ভাই হিসেবে মেরেছি’
লঞ্চঘাটে তরুণীদের প্রকাশ্যে মারধর, যুবক বললেন ‘ভাই হিসেবে মেরেছি’
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
আ.লীগের নিষিদ্ধের বিষয়ে বিএনপি সুস্পষ্ট অবস্থান না নেওয়ায় ছাত্রদল নেতার পদত্যাগ
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান শুরু
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক অভিযান শুরু