X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

হল প্রশাসন ব্যস্ত দোকান নির্মাণে, শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত

ওয়াজহাতুল ইসলাম, জাবি প্রতিনিধি
২৪ জুলাই ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৩, ১০:০০

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীদের খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী জোগান দিতে ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখ, বটতলাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে অনেক দোকান রয়েছে। আবাসিক হলের ডাইনিং ও ক্যান্টিনের বাইরে এই দোকানগুলো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের চাহিদার একটি বড় অংশের জোগান দিয়ে থাকে। ইতোমধ্যে বটতলা, বিভিন্ন আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখগুলোতে পর্যাপ্ত দোকান থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি শিক্ষার্থী বৃদ্ধির কথা বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে নতুন করে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে ও হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে এসব দোকানের ময়লা-আবর্জনা। এর ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির উপর। সৌন্দর্য হারাচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিচরণের উন্মুক্ত পরিসরগুলো। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার পরিবেশ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিস সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক, জয় বাংলা (প্রান্তিক) গেট ও বিশ মাইল গেটের দোকানগুলো এস্টেট অফিসের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এছাড়া আবাসিক হলের আশেপাশের দোকানগুলো সংশ্লিষ্ট হল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকে ও দোকান নির্মাণে এস্টেট অফিসের অনুমতির প্রয়োজন হয় না। আর এর সুযোগ নিয়েই হলগুলোর কর্তৃপক্ষ হলের আশেপাশে ইচ্ছামতো দোকান নির্মাণ করছে। এছাড়া এসব দোকানের জন্য আশেপাশের কতটুকু জায়গা হল কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করতে পারবে তার সীমানা নির্ধারণ করে না দেওয়ায় এস্টেট অফিস এসব দোকান নির্মাণ ও উচ্ছেদে কোনও ভূমিকা রাখতে পারছে না।

আবাসিক হল সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো থেকে জানা যায়, ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আল বেরুনী হলের তত্ত্বাবধানে ৪টি, আ.ফ.ম. কামাল উদ্দিন হলের তত্ত্বাবধানে ১০টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের তত্ত্বাবধানে ২৩টি, শহীদ সালাম-বরকত হলের তত্ত্বাবধানে ২৬টি, শহীদ রফিক-জব্বার হলের তত্ত্বাবধানে ৩১টি,  মীর মশাররফ হোসেন হলের তত্ত্বাবধানে ৬টি দোকান রয়েছে। এছাড়া মওলানা ভাসানী হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তত্ত্বাবধানে পৃথক ২০টির বেশি দোকান থাকলেও তার সঠিক সংখ্যা কাগজপত্র দেখা ছাড়া জানাতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন হলের কর্মকর্তারা। বটতলার কয়েকটি ব্যতীত এসব দোকানের অধিকাংশই গত দুই বছরে নির্মাণ করা হয়েছে।

শহীদ সালাম বরকত হলে পূর্বে ৫টি দোকান

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সম্প্রতি বটতলায় আ.ফ.ম. কামাল উদ্দিন হলের অধীনে নতুন একটি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে হল সংলগ্ন চত্বরটি তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের অধীনে ২২ নম্বর হলের সামনে ৫টি দোকান করা হয়েছে। শহীদ সালাম-বরকত হলের পশ্চিম পাশে ১৫টি ও পূর্ব পাশে ৫টি এবং নবনির্মিত ছাত্র হলগুলোর সামনে ৭টি দোকান নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া আল বেরুনী হল থেকে ইসলামনগর যাওয়ার পথে নতুন করে স্থায়ীভাবে চারটি দোকান গড়ে তোলা হচ্ছে।

অতিরিক্ত দোকান বৃদ্ধির ফলে সৌন্দর্য হারাচ্ছে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো। এসব দোকানে খাবার খেতে আসছেন অনেক বহিরাগত। তাই বাড়ছে জনসমাগম। এছাড়া এসব দোকানের আবর্জনা ফেলার জন্য নেই যথাযথ ব্যবস্থাপনা। এভাবে যত্রতত্র দোকান গড়ে তোলার মাধ্যমে হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কথা না ভেবে নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখছে বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমর্ত্য রায় বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকা স্থায়ী ব্যবসায়িক স্থাপনা করার নিয়ম নেই। এটি আইনসম্মত নয়। করলেও ইটের গাঁথুনির দেয়াল অর্ধেক হবে। প্রশাসন কীভাবে অনুমতি দিচ্ছে সেটা একটা বিষয়। এভাবে দোকান বৃদ্ধির ফলে ডাইনিংগুলোতে খাবারের মান বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতনতা কমে আসছে। এটাই অতিরিক্ত দোকান গড়ে উঠার সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। বাইরের দোকানে খাবারের দাম বাড়ছে, আবার হলের ডাইনিংয়ে দাম অনুযায়ী মান ভালো নয়। আমরা চাই ইউজিসি পুনরায় ডাইনিংয়ে ভর্তুকি চালু করুক। যত্রতত্র দোকান তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। আমরা চাই না তা হোক।’

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের অধীনে ৫টি দোকান

অবাধে দোকান নির্মাণের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শফি মুহাম্মদ তারেক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ভালো হতো যদি ফুড কোর্ট থাকতো, যেখানে দোকানগুলোকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রাখা যায়। যত্রতত্র দোকান সৌন্দর্যের দিক থেকে যেমন ভালো নয়, তেমনি পরিবেশের জন্যও ভালো নয়। শিক্ষার্থীদের চাহিদা থাকায় এই দোকান গড়ে উঠেছে। তবে এসব দোকানের বর্জ্যগুলো নিদিষ্ট কোনও নিয়ম অনুসরণ করে ফেলা হচ্ছে না। যেখানে-সেখানে ফেলার মাধ্যমে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল, শহীদ রফিক-জব্বার হল ও আল বেরুনী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অতিরিক্ত দোকান গড়ে তোলায় সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে হলের ডাইনিং-ক্যান্টিনগুলোতে। প্রশাসন দোকান গড়তে ব্যস্ত, ডাইনিং ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। মানসম্মত খাবার পরিবেশন না হওয়ায় হলের ডাইনিংয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা দিন দিনই কমছে। তারা বাধ্য হয়েই এসব দোকানে খাচ্ছে।

একই কথা বলছেন হল ডাইনিং-ক্যান্টিনগুলোর পরিচালকরা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের ডাইনিং পরিচালক সোহেল রানা বলেন, ‘এক সময় ডাইনিংয়ে অনেক শিক্ষার্থী খাবার খেতো। এখন তা কমে গেছে। ফলে আমরাও ভালো খাবার তাদের সরবরাহ করতে পারছি না। বেশি শিক্ষার্থী খাবার খেলে ভালো মানের বাজার করা যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে অল্প পরিমাণ শিক্ষার্থীর বাজার করতে গেলে খরচ অনেক বেশি পড়ে যায়।’

যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে ময়লা

এদিকে নতুন করে দোকান তৈরির কারণ জানতে চাইলে হল প্রাধ্যক্ষরা কেউ সাবেক প্রাধ্যক্ষদের উপর দায় চাপাচ্ছেন। আবার কেউ শিক্ষার্থীদের অনুরোধ ও অতিরিক্ত চাহিদার দোহাই দিচ্ছেন। অথচ গত তিন শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির আসন বৃদ্ধি পায়নি। এছাড়া সংশ্লিষ্ট হলগুলোর সিনিয়র শিক্ষার্থীদের দোকান তৈরিতে হল প্রাধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছে কিনা জিজ্ঞাসা করা হলে তারা কেউই তা স্বীকার করেননি।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার নতুন দোকান নির্মাণের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এগুলো আমি অনুমোদন দিইনি। আগের প্রভোস্ট কাফী স্যার অনুমতি দিয়ে গেছেন। আমি নিজেও এগুলোর বিপক্ষে।’

আ ফ ম কামাল উদ্দিন হলের ওয়ার্ডেন ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিল। সে প্রেক্ষিতে আমরা একটি ফাস্টফুডের দোকানের অনুমতি দিয়েছি। তবে এর জন্য চত্বরের সৌন্দর্য নষ্ট হবে না। যে দোকান নিয়েছে তাকে শর্ত দেওয়া হয়েছে সেখানে বাগান করে জায়গাটিকে সুন্দর করার।’

যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে ময়লা ৩

স্থায়ীভাবে দোকান নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাইলে আল বেরুনী হলের প্রাধ্যক্ষ সিকদার জুলকারনাইন বিষয়টি জানেন না বলে জানান। তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি জেনেছি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। আমরা এসব দোকান স্থায়ীভাবে কাউকে দিই না। এখানে খাবারের দোকান নয় খাতা-কলমের দোকান হবে।’

২৬টি দোকান থাকার পরেও নতুন করে ১৯টি দোকান নির্মাণের কারণ জানতে শহীদ সালাম বরকত হলের অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুন্ডুর সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

আবাসিক হলগুলোর সামনে নির্মাণ করা এসব দোকানের জন্য হল প্রশাসন থেকে এস্টেট অফিসের অনুমতি নেওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (এস্টেট) আবদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গাগুলোতে ডিমার্কেশন নাই। ফলে হল প্রশাসন হলের আশেপাশের জায়গা নিজেদের বলে মনে করে দোকান তৈরি করে। এগুলোর জন্য এস্টেট বিভাগের অনুমতি নেওয়া হয় না। হল প্রশাসন নিজ উদ্যোগেই করে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

/এমএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এতিমখানায় খাবার দেবে আ.লীগের উপ-কমিটি
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে এতিমখানায় খাবার দেবে আ.লীগের উপ-কমিটি
রিজার্ভ আর সরকারের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না: এবি পার্টি
রিজার্ভ আর সরকারের পতন কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না: এবি পার্টি
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেল: হাইকোর্টের রায় স্থগিত
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের কনডেম সেল: হাইকোর্টের রায় স্থগিত
খুলনায় হত্যা মামলায় ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
খুলনায় হত্যা মামলায় ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
সর্বাধিক পঠিত
সোনার অলংকার কেনাবেচায় নতুন হার নির্ধারণ
সোনার অলংকার কেনাবেচায় নতুন হার নির্ধারণ
পেঁয়াজ আমদানি শুরু
পেঁয়াজ আমদানি শুরু
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
একীভূত হতে পারে কেউ পাস না করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
একীভূত হতে পারে কেউ পাস না করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল